বিজেপির অফিসের সামনে জাতীয় সড়কে পড়ে গুলির খোল। নিজস্ব চিত্র
লাগাতার দু’দিন। বৃহস্পতিবারের পরে শুক্রবারও অশান্তি জারি রইল ভোটের নলহাটিতে। দিনের শেষে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুবিমল পালের নেতৃত্বে পুলিশ নলহাটির বিজেপি কার্যালয় থেকে ২৫ জনকে আটক করেছে। পুলিশের দাবি, বিজেপি-র ওই কার্যালয় থেকে ন’টি কৌটো বোমা, দু’তিনটি ব্যাগভর্তি ইটের টুকরো উদ্ধার হয়েছে। সমস্তটাই পুলিশের তৈরি নাটক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন বীরভূম জেলা বিজেপি নেতৃত্ব। জেলা বিজেপির সভাপতি রামকৃষ্ণ রায় বলেন, ‘‘আগের দিনের তৃণমূলের গুন্ডারা যে কাজ করতে পারেনি, শুক্রবার রামপুরহাট মহকুমা পুলিশ আধিকারিকের নেতৃত্বে তা করে দিয়েছে পুলিশ।’’
বৃহস্পতিবার দুপুরে ধনুকের ছিলায় তির জুড়ে বাম-কংগ্রেসের মনোনয়ন জমা দিতে আসা নিয়ে তেতেছিল নলহাটি-১ ব্লক অফিস চত্বর। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, তৃণমূল ‘আশ্রিত’ কয়েক’শো দুষ্কৃতী বোমা, রড, লাঠি, ধারাল অস্ত্র নিয়ে মিছিলে হামলা চালায়। আর শুক্রবার সকাল থেকেই পুলিশ ছিল তৎপর। পঞ্চায়েত সমিতির দফতরের সামনে জলকামানের একটি গাড়ি রাখা হয়েছিল। নলহাটি শহরে ঢোকার বেশ কিছু রাস্তাতেও সিআরপিএফের জওয়ানদের দিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল।
তাল কাটে বেলা এগারোটার পর থেকে। কলিঠা গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান বৈশাখী দাস মহলদার ও আরও দু’তিন জন সিপিএম প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিতে নলহাটি ১ ব্লক অফিসে ঢুকতে পান বলে অভিযোগ। বৈশাখীর দাবি, ‘‘এক দল মোটরবাইক বাহিনী উইকেট উঁচিয়ে বাধা দেয়। ভিতরে গেলে ভাল হবে না বলে শাসায়।’’ প্রাণভয়ে রণেভঙ্গ দেন তিনি। ইতিমধ্যে আরও কয়েক জন বিজেপি কর্মীকে ব্লক অফিস থেকে ফিরে আসতে দেখে তিনিও তাঁদের সঙ্গে ফিরতি পথ ধরেছিলেন। ব্লক অফিস থেকে তিন কিলোমিটার দূরে, জাতীয় সড়কের ধারে নলহাটি বাসস্টপের কাছেই বিজেপির দলীয় কার্যালয়। সেখানে রামপুরহাট মহকুমা পুলিশ আধিকারিক মিতুনকুমার দে-কে দেখতে পেয়ে গোটা ঘটনা জানাতে আসেন। ইতিমধ্যে বিজেপি-র পার্টি অফিস চত্বরে মনোনয়ন জমা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়ান বিজেপি কর্মীরা।
মিতুনবাবুর কথায়, ‘‘দল বেঁধে ভিতরে যাওয়া যাবে না, সকাল ন’টা থেকে বহু বার বিজেপি কর্মীদের সেটা বুঝিয়েছিলাম। দুপুরের দিকে ফের সে কথা বলতে এলে কিছু লোক সামনে থেকে আমার দিকে আধলা ইট ছুড়ে মারে। আর মেজাজ ধরে রাখতে পারিনি।’’ বিজেপি-র দাবি, এর পরেই পুলিশ যথেচ্ছ লাঠিপেটা শুরু করে। ওই সময়ে কিছু লোক পাল্টা ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করে বলেও দাবি। সেই আঘাতে দু’তিন জন পুলিশ কর্মী অল্পবিস্তর জখম হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তখন মাঠে নামেন এসডিপিও। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, সেই সময় পুলিশ শূন্যে গুলি চালায়। তখনই ছোড়া হয় রবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস।
গোলমাল যখন চরমে, তখন প্রাণভয়ে বিজেপি-র কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন দলীয় কর্মীরা। সিপিএম প্রধান বৈশাখীদেবীও স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গা-ঢাকা দেন। দীর্ঘ সময় ওই কার্যালয় ঘিরে রাখে পুলিশ, কমব্যাট, র্যাফ এবং সিআরপিএফ জওয়ানেরা। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুবিমল পাল ঘটনাস্থলে এসে জনা পঁচিশেককে ওই কার্যালয় থেকে আটক করেন। সুবিমল পাল বলেন, ‘‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়েক জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের কী উদ্দেশ্য ছিল, জানার চেষ্টা চলছে।’’ আটক হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন বিজেপি যুব মোর্চার রাজ্য সাধারণ সম্পাদক ধ্রব সাহা। ধ্রুবর দাবি, ‘‘মহকুমা পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলে দলীয় কার্যালয়ে মনোনয়নের কাগজ তৈরি করছিলাম। বাইরে কারা, কী করেছে জানি না।’’
ভোট নিয়ে এই মার, পাল্টা মারের মধ্যেই ঘটে গিয়েছে পথ দুর্ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এ দিকে, আটক করার পরে দলীয় কার্যালয়ে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, বিজেপির ওই কার্যালয় থেকে ন’টি কৌটো বোমা, দু’তিনটি ব্যাগভর্তি ইটের টুকরো। কার্যালয়ের আশপাশ থেকেও উদ্ধার হয়েছে ইটের টুকরো ভর্তি ব্যাগ, একগোছা বাঁশের লাঠি। পুলিশ সে সবও আটক করেছে।
রামকৃষ্ণ রায় বলেন, ‘‘মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে দলের কর্মীরা জমায়েত করেছিল ঠিকই। কেননা, যা অবস্থা তাতে একা একা মনোনয়ন জমার দিন নেই। রামকৃষ্ণবাবুর কথায়, ‘‘পুলিশ অবশ্য জমায়েত চায়নি। পরিকল্পনা ছিল, এক পেয়ে মারবে। সেই সুযোগ না পেয়েই পুলিশ তৃণমূলের হয়ে কাজ করেছে।’’ পুলিশের বক্তব্য, কে কী বলল তাতে কিছু যায় আসে না। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজই করেছে।