ভোটের নজর শুধু খাতড়ায়

বাঁকুড়া জেলায় এ বার সার্বিক ভাবে নির্বাচন হচ্ছে শুধুমাত্র খাতড়া মহকুমাতেই। যেখানে মরিয়া শাসক, বিরোধী দু’তরফই। বাঁকুড়া সদর মহকুমার কিছু এলাকায় ভোট হলেও বিষ্ণুপুর মহকুমার একটিতেও তা হচ্ছে না।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৮ ০০:১৯
Share:

বুথের-পথে: সেন্টার থেকে জিনিসপত্র নিয়ে যাত্রা। বাঁকুড়া ১ ব্লকে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ

মাওবাদী অশান্তির সময়ে ভোটের দিনে নজরে থাকত বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল। দিন বদল হয়েছে। কিন্তু, ফের পঞ্চায়েত নির্বাচনের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে সেই শাল, পিয়ালের জঙ্গলঘেরা গ্রামগুলো। কারণ, বাঁকুড়া জেলায় এ বার সার্বিক ভাবে নির্বাচন হচ্ছে শুধুমাত্র খাতড়া মহকুমাতেই। যেখানে মরিয়া শাসক, বিরোধী দু’তরফই। বাঁকুড়া সদর মহকুমার কিছু এলাকায় ভোট হলেও বিষ্ণুপুর মহকুমার একটিতেও তা হচ্ছে না।

Advertisement

ভোটের মনোনয়ন পর্বেই রক্ত ঝরে জঙ্গলমহলের রানিবাঁধে। খুন হন বিজেপি কর্মী অজিত মুর্মু। প্রচারের সময়ে রানিবাঁধ সংলগ্ন বারিকুল থানার হিজলি গ্রামে তৃণমূল প্রার্থীর কর্মিসভায় সশস্ত্র হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। জখম হন তিন তৃণমূল কর্মী। জঙ্গলমহলের মধ্যে না পড়লেও খাতড়া মহকুমার তালড্যাংরায় সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অমিয় পাত্রের বাড়িতেও হামলার অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া বিরোধীরা একাধিকবার শাসকদলের বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে মোটরবাইক মিছিল করে গিয়ে শাসানি দেওয়া, বিরোধী প্রার্থীদের তুলে নিয়ে গিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করার অভিযোগ তুলেছে।

যদিও সব ক্ষেত্রেই সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। এত কিছুর পরেও অবশ্য জঙ্গলমহলের চারটি ব্লক রানিবাঁধ, রাইপুর, সারেঙ্গা ও সিমলাপালের বেশির ভাগ আসনেই শাসক ও বিরোধী দলের লড়াই হতে চলেছে।

Advertisement

রাজনীতি সচেতন মানুষজনের মতে, জঙ্গলমহল যখন অশান্ত, সেই সময়েও দক্ষিণ বাঁকুড়া সিপিএমের দখলে ছিল। রাজ্যে যখন পালাবদল হয়ে গেল, সেই সময়েও বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল ধরে রেখেছিল সিপিএম। কিন্তু, গত পঞ্চায়েত ভোটে জঙ্গলমহল দখলে নিয়ে আসে তৃণমূল। দু’বছর আগে বিধানসভা ভোটেও এই এলাকায় দাপট দেখায় শাসকদল। কিন্তু, তারপর থেকেই কিছু কিছু এলাকায় বিজেপি মাথা চাড়া দিতে থাকে। গত বছরে বারিকুলের সাতনালা ল্যাম্পস দখল করে বিজেপি।

বাঁকুড়া জেলা পরিষদের ৪৬টি আসনের মধ্যে ৩১টিতেই বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি। পঞ্চায়েত সমিতির ২২টির মধ্যে ১৩টি এবং ১৯০টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১২৩টিতে বেশির ভাগ আসনেই বিরোধী প্রার্থী নেই। সেখানে খুব কম আসনেই ভোট হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু শাসকদলেরই প্রার্থী রয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে ওই আসনগুলির প্রার্থীদের শংসাপত্র দেওয়ায় স্থগিতাদেশ জারি হয়েছে। তবুও স্বস্তি নেই শাসক শিবিরে।

তালড্যাংরা ব্লক ছাড়া খাতড়া মহকুমার বাকি সাতটি ব্লকের বেশির ভাগ আসনেই বিরোধী প্রার্থী থাকায় লড়াইটা এখানে হাড্ডাহাড্ডি। এই মহকুমার ১৫টি জেলা পরিষদ আসনের ১৪টিতেই ভোট হচ্ছে। বিরোধীদের সঙ্গে পঞ্চায়েতের সব স্তরেই রয়েছে দলেরই গোঁজ প্রার্থীরাও। সব মিলিয়ে খাতড়া মহকুমা নিয়ে শাসকদল যে বেশ একটা স্বস্তিতে নেই, তা মানছেন দলেরই অনেকে।

বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, এ বার পঞ্চায়েত ভোটেও বেশির ভাগ আসনেই তাঁরা প্রার্থী দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, জঙ্গলমহলে অনেকখানি ডালপালা মেলেছে তারা। আড়ালে তৃণমূলের বহু নেতাও মানছেন, লড়াইটা এ বার তাঁদের সঙ্গে বিজেপিরই। প্রচারে আসা তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তৃতাতেও বিজেপি যে প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে, তা শোনা গিয়েছে। প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে সিপিএম বিজেপির পিছনেই।

বিষ্ণুপুর মহকুমার কোতুলপুর, জয়পুর, ইন্দাস, পাত্রসায়রের মতো ব্লকগুলিতে বামফ্রন্ট আমলেও সব আসনে লড়াই হতো না। তখন বিরোধীরা এ জন্য সিপিএমের সন্ত্রাসকেই দায়ী করতেন। তবে এ বার বিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তর্গত ছ’টি পঞ্চায়েত সমিতির কোনওটিতেই ভোট হচ্ছে না। এই মহকুমায় পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরের একটিও আসনে বিরোধী প্রার্থী নেই। এ বার অভিযোগের তির শাসকদলের বিরুদ্ধে।

ছবিটা বদলে গিয়েছে বাঁকুড়া সদর মহকুমাতেও। এই মহকুমার আটটি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে পাঁচটিতে অর্ধেকেরও কম আসনে বিরোধীরা প্রার্থী দিয়েছে। শালতোড়া ব্লকে তিনটিস্তরেই শাসকদলের বিরুদ্ধে প্রার্থী নেই। মেজিয়া ও বড়জোড়া ব্লকে মুষ্ঠিমেয় কিছু আসনে শুধু ভোট হচ্ছে। শুধুমাত্র বাঁকুড়া ১ ও বাঁকুড়া ২ পঞ্চায়েত সমিতিতেই লড়াই হচ্ছে বেশির ভাগ আসনেই। এই মহকুমার জেলা পরিষদের ১৮টি আসনের মধ্যে কেবল মাত্র একটি আসনে তৃণমূলের গোঁজ প্রার্থী নির্দল হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বাকি কোনও আসনেই ভোট হচ্ছে না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বাঁকুড়া সদর মহকুমায় এত কম আসনে ভোট আগে কখনওই হয়নি।

এই পরিস্থিতিতে সব ক’টি রাজনৈতিক দলের নজর এখন খাতড়া মহকুমায়। প্রচার পর্বেও জেলায় দু’টি সভা করেছেন তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা পর্যবেক্ষক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’টি সভাই ছিল খাতড়া মহকুমায়। ভোটের আগের দিনও খাতড়ায় তৃণমূলের ভাল ফল নিয়ে আশাবাদী জেলা তৃণমূল সভাপতি অরূপ খান। তাঁর দাবি, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে জঙ্গলমহলে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। মানুষ উন্নয়নের স্বার্থেই ফের তৃণমূলকেই ভোট দেবেন।” হাল ছাড়তে নারাজ বিরোধীরাও। বিজেপির রাজ্য নেতা সুভাষ সরকারের পাল্টা দাবি, “তৃণমূলের স্বজন পোষণ ও দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে প্রচার চালিয়েছি আমরা। মানুষ বিনা বাধায় বুথে ঢুকতে পারলে জঙ্গলমহল থেকে তৃণমূল উৎখাত হবে।’’

সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক অজিত পতি বলেন, “তৃণমূলের ক্ষমতা থাকলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট করুক। তাহলেই বোঝা যাবে মানুষ কাদের পক্ষে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement