ফাইল চিত্র।
এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচন শুরু হতেই বাঁকুড়ার প্রশাসনিক দফতরের বাইরে দেখা যাচ্ছে এক দল লোককে। হাতে লাঠি, মাথায় হেলমেট। বিরোধীরা নেতারা কটাক্ষ করে বলছেন, ‘‘মোটরবাইক চালানোর সময়ে লাগুক না লাগুক, এই কাজে হেলমেট লাগছে।’’
কারা এরা? শহর জুড়ে এখন এটাই প্রশ্ন। জেলাশাসকের কাছে নালিশ জানাতে গিয়ে তাঁর দফতরের সামনেই আক্রান্ত হয়েছেন বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব। সেটা এই হেলমেট-বাহিনীর কাছেই। মনোনয়নের কাজে মহকুমাশাসকের দফতরে যাওয়ার পথে এরাই চড়াও হয় বাম নেতাদের উপরে। হাতে থাকছে লাঠি, কলার কাঁদির ডাটা। মুখে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান। সেটা দেখিয়ে তৃণমূলের নেতারা বলছেন, বিজেপি না হয়ে যায় না! বিজেপির এক নেতার পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘দলের বুদ্ধি কি এতটাই তলানিতে ঠেকেছে, যে নিজেদের আড়াল করতে যে মুখ ঢাকবে, সেই মুখেই আবার স্লোগান তুলে চিনিয়ে দেবে।’’
কারা নয়, শহরবাসী জানতে চাইছেন, এরা কেন? প্রশ্ন উঠছে, জেলাশাসকের অফিসের সামনেই যদি আক্রান্ত হতে হয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের, তাহলে আমজনতা নিরাপত্তার ভরসা পাবে কোথা থেকে?
এ বারে পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নপর্ব আর গোলমাল প্রায় একই সঙ্গে শুরু হয়েছে। রানিবাঁধে খুন হয়েছেন বিজেপির প্রার্থী। বিভিন্ন ব্লক থেকে অহরহ উঠে আসছে মনোনয়নে বাধা দেওয়ার অভিযোগ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগের আঙুল উঠেছে শাসকদলের বিরুদ্ধে। আর এতে বিব্রত শাসকদলের নেতাদেরই একাংশ। সূত্রের দাবি, দলের অন্দরে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।
জেলা সিপিএমের কিছু নেতা মনে করাচ্ছেন, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের কথা। রাজ্যে পালাবদলের পরে প্রথম পঞ্চায়েত ভোট। সে বার বিষ্ণুপুর, পাত্রসায়র, কোতুলপুর আর জয়পুর ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে কোনও আসনেই প্রার্থী দিতে পারেননি বামেরা। কিন্তু সে বারও পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল না— মন্তব্য সিপিএমের জেলা সম্পাদক অজিত পতির। বিজেপির বাঁকুড়া সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিবেকানন্দ পাত্র বলেন, “মতাদর্শগত বিভেদ থাকলেও অনেক তৃণমূল নেতার সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ভাল। তাঁদের অনেকেই ফোন করে বলেছেন, নিজেদের দলের এই সমস্ত কাণ্ড মানতে পারছেন না।’’
বিরোধীদের প্রশ্ন, এ বার কেন এমনটা করতে হচ্ছে?
রাজ্য সরকারের কোনও না কোনও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের সুবিধা পায়নি, এমন পরিবার গ্রামাঞ্চলে খুবই কম রয়েছে বলে দাবি করেন জেলা তৃণমূলের নেতারা। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, যুবশ্রী, শিক্ষাশ্রীর মতো প্রকল্পগুলির আওতায় এসেছেন প্রচুর মানুষ। বিরোধীরা বলছেন, আসলে দুর্নীতির জন্য পায়ের তলার মাটি আলগা হতে শুরু করছে শাসকদলের। বিজেপির বিবেকানন্দবাবু বলেন, ‘‘প্রকাশ্যে এই সমস্ত হচ্ছে আর পুলিশ-প্রশাসন চোখ বুজে বসে। এর থেকেই তো বোঝা যাচ্ছে, এই সন্ত্রাসে সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থন রয়েছে।’’ তাঁর অভিযোগ, সরকারি প্রকল্পের নামে উপভোক্তাদের থেকে টাকা তুলেছেন শাসকদলের নেতারা। চাকরির টোপ দিয়ে প্রতারণা করেছেন। রাস্তা, নিকাশি বা সেচের বিভিন্ন কাজে তছরুপ হয়েছে সরকারি টাকা। আর সিপিএমের অজিতবাবু বলছেন, ‘‘গত কয়েক বছরে গ্রামাঞ্চলে তৃণমূল নেতাদের রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠা মানুষের চোখে পড়েছে। আর সেটা বুঝতে পেরেই প্রশাসনিক দফতরের বাইরে হেলমেট পরিয়ে, হাতে লাঠি দিয়ে দুষ্কৃতী মোতায়েন করতে হচ্ছে।’’
অভিযোগ না মানলেও ভোটের নামার পথের পুরোটা তৃণমূলের জন্যও যে ফুল-বিছনো নয়, সেটাও মানছেন দলের একাংশ। দু’টি বিষয়ের কথা বলছেন তাঁরা। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। আর বিজেপির উঠে আসা। তাঁরা মনে করাচ্ছেন, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্যই জেলায় দখলে থাকা পাঁচটি বিধানসভা হাত-ছাড়া হয়েছিল তৃণমূলের। দলেরই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর লোকজন নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে ভোট কেটেছেন বিভিন্ন কেন্দ্রে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও জেলা জুড়ে সেই নির্দল কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছিলেন দলের অফিসিয়াল প্রার্থীরা।
শুধু বিরোধীরাই নয়, এমন অনেক গোঁজ প্রার্থীও হেলমেট-বাহিনীর বাধায় মনোনয়ন জমা করতে না পেরে ফিরে এসেছেন বলে তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি। দলের অনেক নেতাই এই সমস্ত গোলমাল সমর্থন করছেন না। তাঁদের বিশ্বাস, কোনও বিতর্ক ছাড়াই ভোট হলেও তৃণমূলই অধিকাংশ আসনে জিততে পারে। এক ব্লক সভাপতি বলেন, ‘‘সব আসনেই যদি অবাধ লড়াই হয়, তাহলেও বিরোধীরা বড় জোর একটা-দুটোয় সুবিধা করতে পারবে।’’ কোনও গোলমাল ছাড়াই ভোট হলে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে সাংগঠনিক শক্তিটাও পরখ হয়ে যেত বলে মনে করছেন তাঁরা।
অবশ্য শাসকদলের জেলা নেতৃত্ব বিরোধীদের সব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অরূপ খান বলেন, “আমাদের দল উন্নয়নের প্রতীক। বিরোধীদের মনোনয়ন আটকে দেওয়ার মতো কাজ আমরা করি না।” জেলা তৃণমূল নেতা তথা বাঁকুড়া জেলা পরিষদের বিদায়ী সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “যেটা হচ্ছে সেটা বাম আর রামের লড়াই। এর সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক নেই।”