খয়রাশোলে দাঁড়িয়েই এক সঙ্গে চলার বার্তা দিলেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল।—ফাইল চিত্র।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক সংঘর্ষে জর্জরিত বীরভূমের এই অঞ্চল দেখেছে শাসক দলের তিন তিন জন ব্লক সভাপতিকে খুন হতে। নানা ঘটনায় সাম্প্রতিক সময়ে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে বারবার। রবিবার বিকেলে সেই খয়রাশোলে দাঁড়িয়েই এক সঙ্গে চলার বার্তা দিলেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। কর্মিসভায় তাঁর নির্দেশ, ‘‘সকলে মিলে চলুন। কথা বলে নিজেদের মধ্যে সমস্যা মিটিয়ে নিন। খয়রাশোলের বুকে আর একটা খুনও যেন না হয়!’’
এ দিন খয়রাশোল ব্লকের তৃণমূল কর্মীদের নিয়ে বুথ ভিত্তিক কর্মী সম্মেলন ছিল ব্লকের সেচ দফতরের মাঠে। সেই কর্মী সম্মেলন থেকেই এমন বার্তা অনুব্রতের। এখানেই শেষ নয়, সংগঠনকে মজবুত করার কাজে ‘গাফিলতি’ থাকায়, সিউড়ির কর্মিসভার মতো এখানেও সরিয়ে দেওয়া হল দলের পরশুণ্ডি অঞ্চলের সভাপতি পরিমল মণ্ডলকে। সঙ্গে সঙ্গে নেতা, কর্মীদের কাছে অনুব্রতের স্পষ্ট বার্তা, ‘‘গত বিধানসভা নির্বাচনের মতো এ বারের লোকসভাতেও এক ফোঁটা রক্ত ঝরবে না। জেলায় এক জন মানুষও খুন হবেন না, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।’’
লোকসভা ভোটের আগে সংগঠন মজবুত করতে এবং খামতিগুলো দূর করার জন্য জেলার প্রতিটি ব্লকে বুথভিত্তিক কর্মী সম্মেলন করছে বীরভূম জেলা তৃণমূল। এ দিন খয়রাশোলে সেই বুথ ভিত্তিক কর্মী সম্মেলনে অনুব্রত ছাড়াও, মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী, দলের জেলা সহ সভাপতি অভিজিৎ সিংহরা উপস্থিত ছিলেন। অন্যান্য কর্মিসভার মতো এ দিনও কর্মীদের ‘ক্লাস’ নিলেন জেলা সভাপতি। খুঁটিনাটি কথার ফাঁকেই জেনে নিলেন খামতি কোথায় কোথায়। বেঁধে দিলেন লোকসভা নির্বাচনে অঞ্চলভিত্তিক লিড কী হবে তার লক্ষ্যমাত্রাও।
কিন্তু খয়রাশোল বীরভূমের আর পাঁচটি ব্লকের মতো নয়। শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আছেই, খুন, সংঘর্ষ, বোমাবাজি লেগেই আছে। আততায়ীর গুলিতে গত বছর অক্টোবরে দলের ব্লক সভাপতি দীপক ঘোষ খুন হওয়ার পরেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছিল। জেলা সভাধিপতিকে মাথায় রেখে ১৪ জনের কমিটি গড়া হলেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মেটেনি। তৃণমূল সূত্রের খবর, গোটা ব্লকে ১০টি অঞ্চলের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। তাই কর্মিসভায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিষয়ে জেলা সভাপতির নিদান কী হয়, তা নিয়ে শুরু থেকেই চর্চা চলছিল। জেলার প্রতিটি ব্লকে অনুব্রত কিছুদিন আগে সম্মেলন করলেও খয়রাশোলই বাদ থেকে গিয়েছিল। রবিবার জেলা সভাপতির নির্দেশের পরে শান্তি ফেরে কিনা, সেটাই দেখার অপেক্ষা।
সভায় প্রথমেই বাবুইজোড় অঞ্চল সভাপতি আবদুর রহমান অনুব্রতের মুখোমুখি হন। তার ঠিক আগেই দলের অভিজিৎ সিংহ অনুব্রতের কাছে গত বিধানসভা ভোটের তথ্য তুলে জানিয়েছেন, অঞ্চলের মোট ১৩টি বুথে লিড ছিল ২৩৭৪টি। অনুব্রত আবদুর রহমানকে প্রশ্ন করেন, ‘‘এ বার কী হবে? উত্তর আসে, ‘‘দু-একটি জায়গায় সমস্যা রয়েছে। তবে সাড়ে তিন হাজার লিড হবে।’’ অনুব্রতের পরের প্রশ্ন, ‘‘কেদারকে (মৃণাল ঘোষ, যিনি আবদুরের বিরোধী গোষ্ঠী এবং দলের বিপক্ষ গোষ্ঠীর নেতা বলেই পরিচিত) ডেকেছিস? উত্তর আসে, ‘‘দাদা ও ফেরার হয়ে আছে।’’ অনুব্রত কারণ জানতে চান। আবদুর রহমান বলেন, ‘‘দীপকদার কেসের আসামি (নিহত ব্লক সভাপতি)।’’ এ কথা শোনার পরেই অনুব্রত আবদুরকে বলেন, ‘‘সবাইকে নিয়ে চলবি। তুই তো মাস্টারি করিস। মনটাকে বড় কর। কেসের আসামি আছে, সেটা আমরা দেখে নেব। আইন আইনের পথে চলবে। পুলিশ পুলিশের কাজ করবে আমরা আমাদের কাজ করব।’’ জেলা সভাপতি একই বার্তা দেন হজরতপুর অঞ্চল সভাপতি স্বপন সেন, রূপসপুরের অঞ্চল সভাপতি শঙ্কর গরাইকেও।
পারশুণ্ডি অঞ্চলের ডাক পড়তেই অনুব্রতের মাথা গরম হয়। অঞ্চল সভাপতি তথা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামী পরিমল মণ্ডলকে অনুব্রত বলেন, ‘‘তিনটি বুথে হেরেছিলেন লিড খুব কম, ১০৬৪। বিধানসভায় যে লিড দেওয়ার কথা বলেছিলেন সেটা দিতে পারেননি স্বীকার করছেন তো?’’ উত্তর আসে, ‘‘দেড় হাজার বলেছিলাম।’’ সঙ্গে সঙ্গে জেলা সভাপতির প্রশ্ন, ‘‘এ বার কী হবে।’’ পরিমল বলার চেষ্টা করেন, ‘‘কিছু অভিমান ছিল।’’ সবচেয়ে বেশি ভোটে অঞ্চলের যে বুথে দল হেরেছিল, সেই বুথের সভাপতিকে দাঁড় করাতে বলেন অনুব্রত। জানতে পারেন সভাপতি মহিলা। কিন্তু তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেই মহিলা বলেন, ‘‘আমি আগে কোনও কাজ করিনি। আজই আমাকে আনা হয়েছে। আমি কিছু জানি না।’’
এ কথা শুনে মঞ্চেই পরিমলকে পদ থেকে সরানোর নির্দেশ দেন অনুব্রত। দল সূত্রের খবর, এলাকায় যথেষ্ট কোণঠাসা ছিলেন পরিমল। যদিও সংবাদমাধ্যমকে অনুব্রত বলেন, ‘‘ওঁর স্ত্রী তো প্রধান পদে রয়েছেন। দু’জনকে এক সঙ্গে পদ নয়। তাই সরানো হয়েছে।’’