সিউড়িতে শিক্ষক নিগ্রহ

নাম জড়াল তৃণমূল নেতাদের

ক্লাস ভর্তি ছাত্রছাত্রীদের সামনেই শিক্ষককে টেনে বের করে এলোপাথাড়ি লাথি ও ঘুসি মারা হয়। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শিক্ষক। কিন্তু ঘটনার পর পাঁচদিন পেরিয়ে গেলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ ওই হামলা নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেননি। এ বার কিছুটা সুস্থ হয়ে সিউড়ির লাঙ্গুলিয়া হাইস্কুলের প্রহৃত শিক্ষক পার্থ মুখোপাধ্যায় নিজেই পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগে জানালেন, হামলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছেন শাসকদলেরই দুই নেতা। তাতেই এই ঘটনা অন্য মাত্রা পেয়ে গেল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৫ ০২:১০
Share:

অভিযোগ জানাতে থানায় পার্থবাবুর ভাই ধনঞ্জয় মখোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।

ক্লাস ভর্তি ছাত্রছাত্রীদের সামনেই শিক্ষককে টেনে বের করে এলোপাথাড়ি লাথি ও ঘুসি মারা হয়। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শিক্ষক। কিন্তু ঘটনার পর পাঁচদিন পেরিয়ে গেলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ ওই হামলা নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেননি। এ বার কিছুটা সুস্থ হয়ে সিউড়ির লাঙ্গুলিয়া হাইস্কুলের প্রহৃত শিক্ষক পার্থ মুখোপাধ্যায় নিজেই পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগে জানালেন, হামলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছেন শাসকদলেরই দুই নেতা। তাতেই এই ঘটনা অন্য মাত্রা পেয়ে গেল।

Advertisement

শুক্রবার পার্থবাবু তাঁর ভাই ধনঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে সিউড়ি থানায় লিখিত ভাবে অভিযোগ দায়ের করে জানান, তাঁকে মানসিক ও শারিরীক ভাবে নিগ্রহের পিছনে মূল হোতা মুক্তার হোসেন খান। তিনি স্কুলের পরিচালন সমিতির সদস্য এবং এলাকার তৃণমূল নেতা। এলাকার আর এক তৃণমূল নেতা তথা অভিভাবক নবি হোসেন খান তাঁর কলার ধরে মারতে মারতে ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে যান বলে অভিযোগে জানিয়েছেন পার্থবাবু। তাঁর সঙ্গে মারধরে হাত লাগিয়েছিলেন আরও কয়েকজন। নাম জড়িয়েছে স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি তথা এলাকার পরিচিত তৃণমূল নেতা সঞ্জিত রায়। পার্থবাবুর অভিযোগ, সঞ্জিতবাবু হামলার সময় নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন।

এ কারণেই কি হামলার ঘটনায় নানা মহল থেকে প্রতিবাদ উঠলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ চুপ থেকে গিয়েছেন? এ দিনও তার সদুত্তর মেলেনি। পুলিশও ওই হামলায় কেন এতদিন কাউকে ধরেনি? পুলিশের দাবি ছিল, পার্থবাবুর ভাই ধনঞ্জয়বাবু অজ্ঞাত পরিচয়রা হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগে জানিয়েছিলেন। কারও নামের উল্লেখ ছিল না। তাই ধরা যায়নি। জ্ঞান ফিরতে পার্থবাবু এ বার নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন। পুলিশ কি এ বার ধরবেন? এই প্রশ্ন বাসিন্দাদের। একই সঙ্গে তাঁদের আশঙ্কা— অভিযুক্তেরা তো শাসকদলের নেতা। পুলিশ ছোঁবে তো!

Advertisement

গত সোমবার সিউড়ি ১ ব্লকের লাঙ্গুলিয়া হাইস্কুলের ইংরাজি শিক্ষক পার্থপ্রতীমবাবুর উপর হামলা করেন আভিভাবকদের একাংশ ও বহিরাগতরা। সেই সময় স্কুলে হাজির ছিলেন স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি তথা তৃণমূলের খটঙ্গা অঞ্চল সভাপতি সঞ্জিত রায়। ওই ঘটনার পর পার্থবাবুকে প্রথমে সিউড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে দু্র্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।

কেন আক্রান্ত হয়েছিলেন ওই শিক্ষক? এর পিছনে অবশ্য ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিভাবকদের ক্ষোভের দোহাই দিয়েছিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি ছিল, ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্র ওই শিক্ষকের নামে কটূক্তি করে বলে অভিযোগ। তাতে শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ কিছু পড়ুয়া গ্রীষ্মের ছুটির আগে ওই ছাত্রটিকে কান ধরে উঠবস করায়। সেই ঘটনাকে ঘিরেই অসন্তোষ দেখা দেয় অভিভাবকদের একাংশের মধ্যে। তাঁদের অভিযোগ, পার্থবাবুর প্রশয়ে ছেলেমেয়েরা অতিরিক্ত স্বাধীনচেতা হয়ে উঠছে। বাড়িতে অভিভাবকদের কথাও শোনে না। তার উপরে ওই ছাত্রটিকে ‘শাস্তি’ দেওয়ার ঘটনায় অসন্তোষের আগুনে ঘি পড়ে। এ দিকে স্কুল কর্তৃপক্ষও গ্রীষ্মের ছুটির পরে এ নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে বৈঠক না করায় তাঁরা নিজেরাই পার্থবাবুর উপর হামলা চালান।

যদিও অভিভাবক ও স্থানীয়দের একাংশের দাবি, বিনামূল্য টিউশন দেওয়া থেকে গরিব পড়ুয়াদের বইপত্র কিনে দেন অকৃতদার পাথবাবু। অতিরিক্ত ছাত্রদরদী হতে গিয়ে কয়েকজন সহ-শিক্ষকের তিনি বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। স্কুল সূত্রের খবর, পার্থবাবু সহ-শিক্ষকদের অনেককের সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা করতেন না। নিজের মতো থাকতেন। তাঁকে বাগে আনতে পারেনি তৃণমূল প্রভাবিত স্কুল পরিচালিত সমিতিও। কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তিনি তাতে বাগড়া গিতেন বলে এ দিনও ক্ষোভ শোনা গিয়েছে কোনও কোনও পরিচালন সমিতির সদস্যদের গলায়। বাসিন্দাদের মতে, এই কারণেই অভিভাবকদের ক্ষোভ প্রশমিত করার বদলে সোমবার তাঁকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার পিছনে মদত দেন পরিচালন সমিতির একাংশ।

পার্থবাবু এখন তাঁর বাড়ি খয়রাশোলের চূড়োরগ্রামে ফিরেছেন। তাঁর হয়ে ভাই ধনঞ্জয় বলেন, ‘‘কোনও তর্কে আমরা যেতে চাই না। দাদা একজন আদর্শ শিক্ষক। ওঁকে যারা হেনস্তা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা চাই। দু’-একজন ব্যক্তি যাদের দাদাকে আক্রমণের পিছনে ভূমিকা ছিল, তাদের নামেই অভিযোগ করেছি। এখানে কোনও দলের নাম জড়ানো ঠিক নয়।’’

কী বলছেন মুক্তার হোসেন খান? তাঁর দাবি, ‘‘সেদিন স্কুলের বাইরে একটা ভিড় জমে ছিল। ওই শিক্ষক নিগৃহীত হতে পারেন খবর পেয়েই আমি ও সভাপতি সঞ্জিত রায় ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক সন্তোষ ভাণ্ডারীর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল ওঁকে বাঁচানো। কিন্তু ভিড় আমাদের অনুরোধ রাখেনি। কিন্তু ওই শিক্ষক আমাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ করলেন! এটা দুর্ভাগ্যজনক। আমি দায়ী কি না, তদন্ত করলেই বোঝা যাবে।’’ তাঁরা যে সেই সময় বৈঠক করছিলেন সে কথা আগেই জানিয়েছেন সঞ্জিতবাবু। তবে মুক্তার হোসেন পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, ‘‘এত শিক্ষক থাকতে শুধুমাত্র পার্থবাবুই কেন এমন হেনস্তার শিকার স্বীকার, কেন ক্ষোভ তাঁর বিরুদ্ধে, তাও তদন্ত করে দেখা দরকার।’’

এতদিন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে মোটেই খুশি নয় শিক্ষকের পরিবার। ঘটনার নিন্দা করে একই অভিযোগ করেছিলেন বামপন্থী শিক্ষক সংগঠন নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতি এবং সেভ ডেমক্রেসি ফোরামের সদস্যেরাও। ঘটনার কিনারা চেয়ে এবং দোষীদের শাস্তি চেয়ে পড়ুয়ারা বুধবার ক্লাসও বয়কট করেছিল। কিন্তু পুলিশের তদন্তে চোখে পড়ার মতো কিছুই ধরা পড়েনি। এবার কী পড়বে? অপেক্ষায় শিক্ষানুরাগীরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement