পথে: বাঁকুড়ায় বিশ্ব এডস দিবসে সচেতনতার প্রচার।নিজস্ব চিত্র
প্রচার চলছে পুরোদমে। যৌনপল্লি থেকে ধাবা— সব জায়গাতেই এডস নিয়ে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। বিলি করা হচ্ছে কন্ডোম। তার পরেও অনেকেই যে সচেতন হচ্ছেন না, বাঁকুড়া জেলা স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যানই তা জানান দিচ্ছে। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম, এইচআইভি পজিটিভ রোগী মিলছে সর্বত্রই। কলেজ পড়ুয়াদের রক্তেও মারণ রোগের ছায়া দেখে আতঙ্কিত স্বাস্থ্য কর্তারা।
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত বাঁকুড়া জেলা জুড়ে ৮১ জন এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর খোঁজ মিলেছে। ২০১৬-তে সংখ্যাটা ছিল ৯৪ জন। ২০১৫ সালে এইচআইভি রোগীর সংখ্যা ছিল ৮৭। গত ক’বছরে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যাটাগুলো কাছাকাছি থাকায়, কেন কমানো যাচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এডস সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে তবে কী ফাঁক থেকে যাচ্ছে?
গত ১৩ বছরে জেলায় এইচআইভি রোগীর সন্ধান মিলেছিল ৫৯৬। তাঁদের মধ্যে ১৫৩ জন এডস-এ আক্রান্ত হন (এইচআইভি আক্রান্তের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে তলানিতে চলে গেলে এডস আক্রান্ত বলা হয়)। মারা যান ৬৫ জন। এ বছরও এডস-এ মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। কেন ঠেকানো যাচ্ছে না এই মারণ রোগ?
জেলার এডস সংক্রান্ত বিষয়টি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা বাঁকুড়ার সহকারী মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিক আশিস মণ্ডল অবশ্য দাবি করেছেন, “চলতি বছরে এইচআইভি রোগীর সংখ্যাটা তুলনামূলক ভাবে কম। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে আমরা যৌনপল্লি থেকে বিভিন্ন ধাবায় যাচ্ছি। এ ছাড়া আশা কর্মীদের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকাতেও প্রচার চালানো শুরু করেছি।”
শুক্রবার বিশ্ব এডস দিবস উপলক্ষে বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর স্বাস্থ্য জেলার উদ্যোগে দিন ভর নানা অনুষ্ঠান হয়েছে। এ দিন সকালে বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুরে স্বাস্থ্য কর্তারা র্যালিতে হাঁটেন। ১৪ নভেম্বর থেকে স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে একটি ট্যাবলো জেলা জুড়ে এডস নিয়ে প্রচার চালায়। এত সত্ত্বেও কেন লাগাম টানা যাচ্ছে না এইচআইভি সংক্রমণে?
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীরা জানাচ্ছেন, সাধারণ মানুষ কন্ডোমের ব্যবহার নিয়ে সচেতন না হওয়াতেই এইচআইভি ছড়াচ্ছে। কন্ডোমে আপত্তি কেন? স্বাস্থ্য দফতর ও এডস নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন স্বেচ্ছ্বাসেবী সংগঠনের কর্মীরা জেলার বিভিন্ন ধাবা ও যৌনপল্লিতে গিয়ে যৌন কর্মীদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছেন।
এক স্বাস্থ্য কর্মীর কথায়, “যৌন কর্মীরা সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, গ্রাহকেরা কন্ডোম কোনও মতেই ব্যবহার করতে চাইছেন না। এই পরিস্থিতিতে আমরা যৌন কর্মীদের কন্ডোম দিয়েছি। কিন্তু মহিলাদের কন্ডোম ব্যবহার তুলনামূলক জটিল বলে তাঁরাও ব্যবহার করছেন না।”
পথে: বিশ্ব এডস দিবসে সচেতনতার প্রচার পুরুলিয়ায়।নিজস্ব চিত্র।
আশিসবাবু বলেন, “এই পরিস্থিতিতে আমরা সরাসরি ট্রাক-লরি চালক বা শিল্পাঞ্চলে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে কন্ডোম ব্যবহারের উপযোগিতা বোঝাচ্ছি। তাঁদের বিনামূল্যে কন্ডোম দেওয়া হচ্ছে।” তাতেও যে বিশেষ একটা কাজ হচ্ছে না পক্ষান্তরে মেনেই নিচ্ছেন আশিসবাবু।
বিপদ বুঝেও কেন কন্ডোম ব্যবহার করেননি? বিষ্ণুপুরের এইচআইভি আক্রান্ত এক ব্যক্তি বলেন, “বন্ধুদের সাথেই যৌনপল্লিতে গিয়েছিলাম। কেউই কন্ডোম ব্যবহার করেনি। ওদের দেখে আমিও কন্ডোম নিলাম না। আজ বুঝতে পারছি কত বড় ভুল করেছিলাম।” এইচআইভি আক্রান্ত বড়জোড়ার এক ঠিকা শ্রমিক বলেন, “দীর্ঘ দিন ধরেই এক যৌন কর্মীর কাছে যাতায়াত ছিল আমার। অনেক দিন ধরে চিনতাম বলে ভাবতেই পারিনি ওর কাছ থেকে রোগ ছড়াতে পারে। তাই সব জেনেও কন্ডোম ব্যবহার করতাম না।”
আশিসবাবু জানাচ্ছেন, এডস নির্মূল করতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরও সচেতন করার কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, “এটা একটা বৃহত্তর লড়াই। সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষকে বুঝতে হবে, বিপদ এড়াতে গেলে কন্ডোম ব্যবহার করতেই হবে।” কিন্তু তাতেও স্বস্তি মিলছে কই? জেলার এক স্বাস্থ্য কর্তা জানাচ্ছেন, রক্তদান শিবির থেকে সংগ্রহ করা রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে কলেজ ছাত্রদের মধ্যেও এইচআইভি আক্রান্তের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে।
ঘটনাগুলি হয়তো বিচ্ছিন্ন। কিন্তু যাদের ভরসা করছে স্বাস্থ্য দফতর, সেই নতুন প্রজন্মই যদি বেহিসাবি হয়, তবে কী ভাবে নিমূল হবে এই মারণ রোগ?