পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার ও বিশ্বজিৎ ঘোষ।
চোখের ডাক্তারের চেম্বার যেমন হয়ে থাকে! এক দিকে কম্পিউটার-সহ ডাক্তারবাবুর ছিমছাম, পরিষ্কার টেবিল। পাশে একটু দূরে, রোগীদের বসার চেয়ার, সামনে লম্বাটে অটোরিফ্র্যাক্টোমিটার। আমার মতো চালশে-ধরা অনেক রোগীই এই যন্ত্রটা চেনেন। চিবুক রেখে এক বার ডান চোখে সামনের লেন্সে তাকাতে হয়, আর এক বার বাঁ চোখে।
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘এই গানটাই ধরুন’। কম্পিউটারে বেজে উঠল, ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো।’ ডাক্তারের কম্পিউটারে গানও থাকে! এ কি সুরশুশ্রূষা? ১৯৩২ সালে পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে এই গান গেয়ে রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজির অনশন ভঙ্গ করেছিলেন। ডাক্তারবাবু হাসলেন, ‘গানটা কিন্তু অনেক আগে, ১৯১০ সালে লেখা। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মাঘোৎসবে প্রথম গাওয়া হয়েছিল। তার দুই দশক পরে গান্ধীজির ঘটনা।’ এই চক্ষুবিশেষজ্ঞ পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকারের ‘গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার’ এ বারের, ১৪২৯ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত।
বাছাই পর্বে গোলাম মুরশিদের নজরুল-জীবনী ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়’, সুব্রত চট্টোপাধ্যায়ের ‘চেতনা: বিজ্ঞান, ধর্ম ও দর্শনের আলোকে’ বইগুলিও ছিল। কিন্তু শেষ অবধি নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, পার্থ ঘোষ, বাংলাদেশ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিশ্বজিৎ ঘোষ, আবুল বাশার, যশোধরা রায়চৌধুরীকে নিয়ে তৈরি পাঁচ সদস্যের বিচারকমণ্ডলী পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার শেষে পূর্ণেন্দুবাবুর ডাবল ডিমাই সাইজের চওড়া বইটিকেই জয়তিলক পরিয়েছেন। যে বইয়ের কোনও একটি পৃষ্ঠা খুললেই চোখের সামনে রাখা সারণিতে ধরা দেবে গানটি কবে লেখা, তার উৎসগ্রন্থ, রচনাকাল, স্বরলিপিকার থেকে কোন রাগ, কবে সেটা প্রথম গাওয়া হয় ইত্যাদি হরেক তথ্য! সেখানেই এই বইয়ের চমৎকৃতি! ‘চেয়েছিলাম, হাতের কাছে যাতে চটজলদি যে কেউ তথ্যগুলি পেতে পারেন,’ বলছেন ডাক্তারবাবু।
এই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, চ্যাটজিপিটির যুগে, যেখানে কোনও বিষয়ে তিন মিনিটের বেশি মনঃসংযোগ দুঃসাধ্য, সেখানে নয়নসুখকর এই তথ্যভান্ডার অবশ্যই এক উজ্জ্বল উদ্ধার। এখন মোবাইলে অক্লেশে শুনে নিতে পারেন প্রিয় গায়ক বা গায়িকাকে। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত তো শুধু সুরের ঝর্নাতলাতেই শেষ হয়ে যায় না। ৭৪ বছর আগে, বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’ উপন্যাসের নায়ক সত্যেন তার প্রেমিকা স্বাতীকে দুই খণ্ড গীতবিতান উপহার দিয়ে বলেছিল, ‘রবীন্দ্রনাথের গান তো শুধু কান দিয়ে শোনবার নয়, মন দিয়েও পড়বার।’ কোভিড-পর্বের দুঃসময় পেরিয়ে এ বারের আনন্দ পুরস্কার সেই ধ্রুপদী ঐতিহ্যকেই যেন বাঙালির সামনে ফের নতুন করে ধরে দিল।
গান অবশ্য সাহিত্য পুরস্কারের অন্তরাতে এ বারই প্রথম বাজল না। সাত বছর আগে সাহিত্যের জন্য বব ডিলান নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হওয়ার পরে সলমন রুশদি বলেছিলেন, ‘সাহিত্যের সীমানা ভেঙেচুরে ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে, নোবেল কমিটি যেন সেই সত্যকেই আজ স্বীকৃতি দিল।’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের হাত ধরে আনন্দ পুরস্কারও এ বার প্রসারিত করে দিল গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধের সৃজনসীমা। বাঙালির মনে পড়তে পারে, শিক্ষা, জাতীয়তাবাদ বা পরিবেশ নিয়ে নয়, রবীন্দ্রনাথের প্রথম পাবলিক বক্তৃতা ছিল ‘সংগীত ও ভাব’ নিয়ে। ১৮৮১ সালে, মেডিক্যাল কলেজ হলে।
বিচারকমণ্ডলী: পার্থ ঘোষ, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, যশোধরা রায়চৌধুরী, আবুল বাশার।
কাকতালীয় ভাবে, উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙা অঞ্চলের ছেলে পূর্ণেন্দু সেই মেডিক্যাল কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। সার্জারি, মেডিসিন, গাইনি, এ সব বাদ দিয়ে চোখ কেন? সেখানে কি ছিল রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতাকে খুঁটিয়ে দেখার প্রয়াস? লেখক-ডাক্তার হাসলেন, ‘না, না, রবীন্দ্রনাথের অসুখের কথা তখনও জানতাম না। আসলে চোখে সার্জারি, মেডিসিন দুটোই সমান ভাবে জড়িয়ে। সকালবেলা অপারেশন করলাম, বিকেলে রোগী জানাল, ডাক্তারবাবু, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। এই জিনিসটা খুব ভাল লাগত।’ সেই ভাল লাগা থেকেই কি চক্ষুবিশেষজ্ঞ আজ বাংলা ভাষাতেই অন্য আলোর সন্ধানে? এই গীতবিতান তথ্যভান্ডারেরও আগে রবীন্দ্রনাথের সাড়ে তিন হাজার কবিতার তথ্য, আবৃত্তি ও গানের ডিজিটাল সংস্করণ নিয়ে ২০০৬ সালে তৈরি করেছিলেন গীতবিতান আর্কাইভ। মাউসের এক ক্লিকেই শোনা যেত গান, জানা যেত কোন সময়ে লেখা, কবে প্রথম রেকর্ডিং!
সেই আর্কাইভ উদ্বোধনেই ডেকেছিলেন শঙ্খ ঘোষ ও সুচিত্রা মিত্রকে। সুচিত্রা সে দিনই তাঁকে বলেছিলেন, ‘ডিজিটাল ভাল। কিন্তু বই থাকলে আমার মতো লোকেরও সুবিধা হয়।’ স্মিত হেসে ঘাড় নেড়েছিলেন শঙ্খবাবুও। তাঁর সাহায্য নিয়েই ২০০৮ থেকে ফের গানগুলি নিয়ে আরও তথ্য জোগাড়। টানা আট-নয় বছর পরিশ্রমের পরে বই। ‘গান বিষয়ে বিভিন্ন তথ্যকে যে ভাবে তিনি কয়েকটি সারণির মধ্যে বিন্যস্ত করেছেন এখানে, তাতে এক লহমাতেই নানা খবর পাঠকের গোচরে আসে—এ একটা মস্ত সুবিধে,’ এই বই সম্পর্কে লিখেছিলেন শঙ্খবাবু। পুরস্কারের খবর পেয়ে প্রথমেই তাঁর কথা মনে পড়ছে লেখকের, ‘ওঁকে খুব মিস করছি। উনি থাকলে আজ খুব খুশি হতেন।’
সারণি তো শুধু তালিকা নয়। আর একটু বেশি। প্রতিটি গানই তো এক-একটা স্মৃতি, এক-একটা আলাদা গল্প। শিলাইদহ থেকে বোটে সাজাদপুর যাচ্ছেন, প্রবল ঝড়বৃষ্টি, আকাশ কালো এবং অন্ধকার। নদী উত্তাল। তারই মধ্যে গান লিখলেন, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা।’ সব স্মৃতি সারণিতে ধরে না। কিন্তু রসায়নে আগ্রহী কোনও ব্যক্তি তো মেন্ডেলিফের পর্যায়-সারণি দেখেই ঝটিতি বুঝে যায়, কোন মৌলের কী ধর্ম! ট্রাফিক সিগনালে, পঁচিশে বৈশাখে রবীন্দ্রপুজো, রবীন্দ্রবিরোধিতা, রাবীন্দ্রিকতার তত্ত্ব অনেক হল। কিন্তু হাতের কাছে, সারণিবিন্যস্ত তথ্য? পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকারের সেই পরিশ্রমী তথ্যচয়নকেই এ বারের আনন্দ-কুর্নিশ!