গর্ভে সন্তান, স্বামী বন্দি সুদূর তানজানিয়ায়, হাঁড়ি চড়ছে না নীপার সংসারে

নীপা বিশ্বাসের গর্ভে ছ’মাসের সন্তান। মানুষটা যাওয়ার আগে শেষ বার ডাক্তার দেখিয়ে গিয়েছিল। যা টাকা হাতে দিয়ে গিয়েছিল, সব শেষ। ডাক্তার দেখানোর টাকাও নেই। এক দিকে সুদূর তানজানিয়ার জেলে বন্দি স্বামীর ভবিষ্যৎ, অন্য দিকে পেটের ভিতরে একটু-একটু করে বেড়ে ওঠা সন্তান— এই দুইয়ের উদ্বেগে ঘুম ছুটেছে বিদ্যুৎ বিশ্বাসের স্ত্রী নীপার। 

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা 

বগুলা শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৮ ০৩:১০
Share:

উৎকণ্ঠায় পরিবার। নিজস্ব চিত্র

মাত্র দু’হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল মানুষটা। চোখে লেগে ছিল সুন্দর জীবনের স্বপ্ন। বলে গিয়েছিল, “একটা মাস একটু কষ্ট করে চালাও। বেতন পেয়েই পাঠিয়ে দেব।”

Advertisement

মাস পার হয়ে গিয়েছে, টাকা আসেনি। পরিবর্তে ফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে এসেছে কান্নার শব্দ, “আমাদের তোমরা যেমন করেই হোক উদ্ধার করে নিয়ে যাও। এরা আমাদের খেতেও দিচ্ছে না!”

নীপা বিশ্বাসের গর্ভে ছ’মাসের সন্তান। মানুষটা যাওয়ার আগে শেষ বার ডাক্তার দেখিয়ে গিয়েছিল। যা টাকা হাতে দিয়ে গিয়েছিল, সব শেষ। ডাক্তার দেখানোর টাকাও নেই। এক দিকে সুদূর তানজানিয়ার জেলে বন্দি স্বামীর ভবিষ্যৎ, অন্য দিকে পেটের ভিতরে একটু-একটু করে বেড়ে ওঠা সন্তান— এই দুইয়ের উদ্বেগে ঘুম ছুটেছে বিদ্যুৎ বিশ্বাসের স্ত্রী নীপার।

Advertisement

আফ্রিকার তানজানিয়া কোথায়, তার কোনও আন্দাজ নেই হাঁসখালির পশ্চিম হরিণডাঙা গ্রামের বেশির ভাগ বাসিন্দার। গত ১৯ অক্টোবর যে ১৭ জন রওনা দিয়েছিলেন, তাঁদেরও ছিল না। এর মধ্যে আট জন গত ২৬ অক্টোবর মুম্বই থেকে বিমানে ওঠেন। বাকিদের টিকিট ছিল ২৮ তারিখের। এর মধ্যে তানজানিয়ায় দীর্ঘদিন থাকা এক চাচার সাহায্যে প্রথম দলের এক জন মেল করে জানান, বাকিরা যেন বিমানে না ওঠেন। সেখানে পরিস্থিতি খুবই খারাপ।

সে কথা জেনে বাকিরা যোগাযোগ করেন তাঁদের এজেন্ট, গ্রামেরই বাসিন্দা শ্রীমন্ত বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি আশ্বাস দেন, একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। দু’দিনে ঠিক হয়ে যাবে। তা শুনে বাকি ন’জন মুম্বইতেই থেকে যান। এঁদের এক জন উৎপল মণ্ডল দিন কয়েক আগে বাড়ি ফিরেছেন। রবিবার একমুখ হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, “শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যেতে চেয়েছিলাম। মাথার উপরে প্রায় সওয়া এক লক্ষ টাকার দেনা। ফিরে এলে শোধ করব কী করে?”

ওঁরা সকলেই গরিব কাঠের মিস্ত্রি। সেই অভাবের সুযোগ নিয়েই মোটা বেতনের কাজের কথা শুনিয়েছিল শ্রীমন্ত। উৎপলের দাবি, তাঁরা সকলে মাসিক পাঁচ শতাংশ সুদে ঋণ করে টাকা দিয়েছিলেন শ্রীমন্তের হাতে। কথা ছিল, তানজানিয়ায় মাসে ৬০ হাজার টাকা করে বেতন পাবেন। তা দিয়ে কয়েক মাসে ঋণ শোধ করবেন। হাঁসখালি থানার পুলিশ শুক্রবার রাতেই কলকাতা থেকে শ্রীমন্তকে ধরে। এ দিন কৃষ্ণনগর আদালতে তোলা হলে তাকে পাঁচ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে পাঠানো হয়েছে।

শ্রীমন্তকে জেরা করে জানা গিয়েছে এই পাচার চক্রের আরও এক মাথা সানি সিংহর নাম। তানজানিয়ার দার-এস-সালাম শহরে কাজের জন্য সানির মাধ্যমেই পাঠানো হয় নদিয়ার এই শ্রমিকদের। কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর পরেই ভিসা সংক্রান্ত নথিতে গোলমাল পাওয়া যায়। তার পরেই তাঁদের বেআইনি ভাবে তানজানিয়ায় থাকার জন্য গ্রেফতার করা হয়। জেল থেকে কোনও মতে একজন তাঁর নদিয়ার পরিবারকে খবর দেন। জেল বন্দিদের উদ্ধার করার জন্য তাঁদের পরিবার যোগাযোগ করে ন্যাশনাল অ্যান্টি-ট্রাফিকিং কমিটি নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে। তাঁদের চেয়ারম্যান জিন্নার আলি বলেন, “ এঁদের ওয়ার্ক পারমিটে তানজানিয়ার শ্রম দফতরের যে নথি ছিল, সেটা জাল ছিল। সেই কারণেই সবাইকে গ্রেফতার করা হয়। ওখানকার স্থানীয় আদালত ছ’মাসের কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ তানজানিয়ান সিলিং জরিমানা করে।”

আরও পড়ুন: কনের সাজে ঝুলন্ত স্ত্রী, আমগাছে ঝুলছে স্বামীও, হাতের তালুতে লেখা...

এর পর ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যেই গ্রেফতার করা হয় নদিয়ার মূল দালাল শ্রীমন্তকে। তাঁকে জেরা করেই চক্রের বাকিদের হদিশ পাওয়ার চেষ্টা করছে পুলিশ। চেষ্টা চালানো হচ্ছে জেলবন্দিদের ফিরিয়ে আনারও। জেলবন্দিদের মধ্যেই রয়েছেন, একই পরিবারের দুই ভাই সুজিত মণ্ডল ও সুব্রত মণ্ডল। সুব্রতর দেড় বছরের মেয়ে রয়েছে। কয়েক দিন ধরে দুধ জোটেনি তার। তাঁর স্ত্রী মামনি বলেন, “ও এক মাসের চাল-ডাল কিনে দিয়ে গিয়েছিল। ফুরিয়ে গিয়েছে। হাতে যে ক’টা টাকা ছিল তা-ও শেষ। মেয়ের দুধ যে কিনব, তার টাকা কোথায়?”

আরও পড়ুন: ‘সব ধ্বংস করে দেব...’ জেটের বিমানে সন্দেহজনক ভিডিয়ো চ্যাট, কলকাতায় আটক যুবক

প্রায় একই দুরবস্থা প্রতিটি পরিবারের। মামনিদের আক্ষেপ, জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, দেখা হয়নি। সমস্ত নথি রেখে এসেছেন কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতেও। এই ক’দিনে আরও নানা জায়গায় ছুটতে হয়েছে তাঁদের। টাকা শোধ করতে পারবে কি না সন্দেহে কেউ দশটা টাকাও ধার দিতে চাইছে না। গাঁয়ের দোকানগুলোও ধারবাকি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

অসহায়তা কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, তা স্পষ্ট হয়ে যায় বাপি মণ্ডলের বৃদ্ধা মা শিখা মণ্ডলের কথায়। তিনি বলছেন, “ছেলে কষ্টে আছে। মনে হচ্ছে, এখনই বাড়ি ফিরে আসুক। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, ও যদি ফিরে চলে আসে, মাথার উপরে যে ঋণের বোঝা চেপেছে, তা নামাব কী করে!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement