রাজু ঝা। ফাইল চিত্র।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারিও কি তিনিই নিশানা ছিলেন?
সেই রাতে আধো অন্ধকারে দুর্গাপুর শহরের অভিজাত অম্বুজা এলাকায় একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় একটি মোটরবাইক। আরোহী দু’জনকে ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না। আচমকাই তারা বাড়িটির একতলায় একটি অফিস লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে। গুলির চিহ্নও পরে পাওয়া যায় বাড়ির দেওয়ালে। তার পরে যে ভাবে এসেছিল, সেই ভাবেই বাইকটি ফিরে যায় গতি তুলে।
ঘটনাটি নিয়ে হইচই পড়ে যায় বিভিন্ন মহলে। সূত্রের খবর, একটি প্রভাবশালী মহল থেকে এমনও জানতে চাওয়া হয়, এই হামলার সঙ্গে কয়লার বেআইনি কারবারের কাগজপত্র নষ্ট করার কোনও যোগ আছে কি? কিন্তু পরে তদন্তে দেখা যায়, হামলাকারীদের নিশানা ছিলেন রাজেশ ওরফে রাজু ঝা। যে বাড়িতে আচমকা হামলা চলেছিল, সেটি রাজুরই এক সহযোগীর দফতর।
২৬ ফেব্রুয়ারি বেঁচে গেলেও ১ এপ্রিল আর শেষরক্ষা হল না। এ বারে অনেক আটঘাট বেঁধেই এসেছিল আততায়ীরা। রাজুর খুন এর মধ্যেই একাধিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। যেমন, কেন বার বার নিশানা করা হচ্ছিল রাজুকে? কেনই বা খুনের রাতে তাঁর সঙ্গে দেখা গেল গরু কারবারি শেখ আব্দুল লতিফকে? লতিফের সঙ্গে রাজুর যোগাযোগ কবে থেকে এবং তা কতটা গভীর? দু’জনের মধ্যে কি লেনদেনের কোনও সম্পর্ক ছিল?
পুলিশ এখনও এই তদন্তে খুব বেশি এগোতে পেরেছে বলে প্রমাণ মেলেনি। ওয়াকিবহাল মহল সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, রাজু যদি হন কয়লা কারবারের অন্যতম পান্ডা, লতিফ তবে ছিলেন গরু কারবারের গুরুত্বপূর্ণ কান্ডারি। বালি-পাথরের কারবারেও যোগ রয়েছে তাঁর। ২০১৩ সালে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ‘নজরে’ আসেন লতিফ। তাঁর বাড়ি ইলামবাজারের সুখবাজার এলাকায়। বীরভূমে যে দু’টি সব থেকে বড় গরুর হাট রয়েছে, তার একটি সুখবাজারে। গত কয়েক মাসে ইডি, সিবিআইয়ের তদন্তে জানা গিয়েছে, এই হাট থেকে পাচারের গরুর জন্য ভুয়ো চালান তৈরি করা হত এবং এখান থেকেই সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে যেত গরু। এই কাজে যাঁরা জড়িত বলে সন্দেহ তদন্তকারীদের, তাঁদের তিন জন, অনুব্রত মণ্ডল, এনামুল হক এবং সেহগাল হোসেন এখন তিহাড় জেলে। বাকি রয়েছেন শুধু লতিফ। যাঁর খোঁজ এখনও সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা পাননি বলেই দাবি।
গরু ও কয়লা কারবারের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল লোকজনেরা বলছেন, সিবিআই তদন্ত শুরু হওয়ার পরেই কিন্তু রাজু ও লতিফের সম্পর্ক তৈরি হয়। সূত্রের দাবি, রাজু সম্পর্কে যতই সাংসদ অর্জুন সিংহ দাবি করুন যে, রাজুকে তৃণমূলের কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছিল, বাস্তব কিন্তু তা বলছে না। বরং বাম আমলে কয়লা সাম্রাজ্যের অন্যতম নায়ক হয়ে ওঠা রাজু ২০১১-তে পালাবদলের পরে কিছুটা কোণঠাসাই হয়ে পড়েছিলেন বলে জানাচ্ছেন কয়লা এলাকার লোকজন। সেই সময়ে উত্থান অনুপ মাজি ওরফে লালার। রাজুর ঘনিষ্ঠমহল থেকে জানা যায়, কয়লা পাচারের অভিযোগে কয়েক বার জেল খাটার পরে রাজু ফের বাম নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। এমনও দাবি করা যে, ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে তিনি বামেদের একটি মহলের কাছ থেকে জানতে চান, তৃণমূলের হারের সম্ভাবনা কতটা। তা হলে তিনি নতুন করে কয়লা কারবারে ফিরতে পারেন। কিন্তু পালাবদল হয়নি। এবং বিধানসভা ভোটের পরেই তাঁকে ফের গ্রেফতার করা হয়। রাজুর এই টানাপড়েনের ইতি আরও পাঁচ বছর পরে, ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে। তিনি তখন বিজেপিতে যোগ দেন।
গরু কারবারের বড় মাথা লতিফ কিন্তু তৃণমূল জমানায় লালার সঙ্গেই হাত মিলিয়ে ব্যবসা করতেন। ২০২০ সালে সিবিআই কয়লা পাচার তদন্তে হাত দেয়। সেই বছরই পুরোপুরি ভেঙে যায় লালার ‘সিন্ডিকেট’। পরের বছর রাজু পুরনো উদ্যমে নামেন কয়লা কারবারে। দ্রুত প্রভাব-প্রতিপত্তিও বাড়ছিল তাঁর।
এই পরিস্থিতিতে লতিফ যোগাযোগ করেন রাজুর সঙ্গে। তৈরি হয় নতুন সমীকরণ।
(চলবে)