গোপাল তিওয়ারি।
মাৎস্যন্যায় নয়। রাঘববোয়াল শিকার করতে চুনোপুঁটির টোপ!
দুষ্কৃতীদের কব্জায় আনতে অন্য কিছু দুষ্কৃতীকেই ‘সোর্স’ হিসেবে ব্যবহারের কৌশল বহু পুরনো। এ-সব ক্ষেত্রে যাকে বা যাদের নিশানা করা হয়, তার বা তাদের বিরোধী গোষ্ঠীর মেজো-সেজো বা ছোট দুষ্কৃতীকে কাজে লাগিয়ে থাকে পুলিশ। মধ্য কলকাতার দাগি দুষ্কৃতী গোপাল তিওয়ারির হদিস পেতে সেই পুরনো পন্থাই নিচ্ছে লালবাজার। অনেকটা রাঘববোয়াল ধরতে চুনোমাছের টোপ ফেলার কায়দাতেই।
কলকাতা পুরসভার ভোটের সময় গিরিশ পার্ক এলাকায় পুলিশ অফিসারকে গুলি করার ঘটনায় খোঁজ চলছে বড়বাজারের দাগি দুষ্কৃতী গোপালের! তাকে বাগে আনতে চুনোপুঁটি দুষ্কৃতীদের হাতিয়ার করা হচ্ছে। গোপালের পরিচিত খুদে দুষ্কৃতীদের মাধ্যমে চলছে তার হাঁড়ির খবর সংগ্রহ। ওই ‘খুদেদের’ মাঠে নামিয়েই কাজ হাসিলের চেষ্টা শুরু হয়েছে। ১৮ এপ্রিল পুরভোটের বিকেলে গিরিশ পার্কে সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডলকে গুলির ঘটনার কিনারা করতে এ ভাবেই এগোচ্ছে পুলিশ। লালবাজারের কর্তাদের আশা, কান টানলেই মাথা আসবে। সঙ্গী-শাগরেদদের ধরতে পারলেই পুলিশের গোপাল-লাভ নিশ্চিত। তাই ‘সোর্স’ হিসেবে গোপালের বিষয়ে ওয়াকিবহাল কয়েক জন চুনোপুঁটিকে ইতিমধ্যেই বাছাই করা হয়েছে। এবং তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই গোপালের ডানহাত ছোট্টু, বাবলি-সহ একাধিক দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশি সূত্রের খবর, সন্দেহভাজন জনা কুড়ি দুষ্কৃতীকে চিহ্নিত করেছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। তাদের বেশির ভাগই গোপালের ঘনিষ্ঠ। বাকিরাও আর এক পলাতক দুষ্কৃতী ‘মোটা রাজা’র পরিচিত। গিরিশ পার্ক-বড়বাজারে গত দে়ড়-দু’বছরে ওই দুষ্কৃতীরা রাজ্যের শাসক দলের কর্মী পরিচয়েও ‘প্রতিপত্তি’ অর্জন করেছে। কিন্তু গোপাল বা রাজার সঙ্গে এদের অনেকের খানিকটা ব্যক্তিত্বের সংঘাতও আছে। ওই দুষ্কৃতীদের বিরোধটাকেই এখন পুরোদমে কাজে লাগাচ্ছে পুলিশ।
কী ভাবে এগোচ্ছে সোর্স-বাহিনী?
গোয়েন্দারা জানান, গোপাল বা অন্য কোনও পলাতক অভিযুক্তই মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে না। ফলে মোবাইল ফোন ‘ট্র্যাক’ করেও কোন লাভ হচ্ছিল না। অভিযুক্তদের কোনও তথ্যই মিলছে না দেখে তাঁরা অন্য পথ ধরেন। পলাতকদের ধরার জন্য এলাকায় থাকা ছোটখাটো দুষ্কৃতীদের সোর্স হিসেবে কাজে নামানো হয়। ‘সাফল্য’ও মেলে। ২৯ এপ্রিল সকালে মধ্য কলকাতার সোর্স মারফত লালবাজারের গোয়েন্দারা টাটকা খবর পান, গোপালের ডানহাত ছোট্টু রয়েছে বীরভূমের নলহাটিতে। ৩০ এপ্রিল রাতে সেই গোপন ডেরায় হানা দিয়ে ছোটুকে গ্রেফতার করা হয়। গিরিশ পার্কের ঘটনায় এ-পর্যন্ত তদন্তকারীরা মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করেছেন।
তদন্তকারী এক অফিসারের কথায়, ‘‘আমরা ওই এলাকার বেশ কিছু ছোটখাটো দুষ্কৃতীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তারা সরাসরি সে-দিনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়। এবং বেশির ভাগই গোপাল-বিরোধী। তাতেই সাফল্য মিলছে।’’
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, পুরভোটের দিন সকাল থেকেই ২০টির বেশি মোটরবাইক নিয়ে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গিরিশ পার্কের সিংহিবাগান-সহ লাগোয়া এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল জনা চল্লিশ দুষ্কৃতী। ভোট শেষ হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই ওই এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন পুলিশ অফিসার জগন্নাথবাবু। তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, শাসক দলের কিছু নেতার মদতে ওই ঘটনা ঘটিয়েছে গোপাল ও তার দলবল।
গোপাল-সহ ওই ঘটনায় অভিযুক্ত বেশ কয়েক জনের সঙ্গে রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা, কাউন্সিলর স্মিতা বক্সী এবং এলাকার তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর ছবি পাওয়া গিয়েছে। নেতানেত্রীদের বিভিন্ন সভায় মঞ্চে ছিল গোপাল। তবে শাসক দলের নেতানেত্রীরা গোপাল-সংস্রবের যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বিষয়টি স্পর্শকাতর বুঝেই গোপাল-বাহিনীকে পাকড়াও করতে সাবধানে এগোচ্ছে পুলিশ।
গোড়ায় অবশ্য তরতরিয়েই এগোচ্ছিল পুলিশি তদন্ত। দুই তৃণমূলকর্মী-সহ ছ’জনকে গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু গোপাল হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ায় গোলযোগের সূত্রপাত। লালবাজার সূত্রের খবর, ছোটখাটো দুষ্কৃতীদের কাজে লাগিয়ে এখন সেই মুশকিল আসানের চেষ্টাই চলছে।