পুলিশের দাবি নস্যাৎ হয়ে গেল ময়না-তদন্তের রিপোর্টে।
মারধরের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে পুলিশ বলেছিল, পেটের অসুখ চাগাড় দেওয়াতেই বড়তলা থানার লক-আপে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মরাঠি যুবক ভূষণ দেশমুখ। এবং সেই অসুস্থতার জেরেই ২৫ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
কিন্তু শব-ব্যবচ্ছেদের রিপোর্ট বলছে একেবারে উল্টো কথা। ভূষণের ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে ধরা পড়েছে, অসুখ-টসুখ নয়। এক-আধটা যেমন-তেমন ঘা-ও নয়। তাঁর দেহে ১৩টি গভীর ক্ষত ছিল। এবং ওই সব ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল পুলিশের লক-আপে থাকাকালীন উপর্যুপরি আঘাত আসায়। তার মধ্যে দু’টি গভীর ক্ষত মৃত্যুর প্রায় তিন দিন আগেকার। বাকি ১১টি ক্ষতই হয়েছে মৃত্যুর ৪৮ ঘণ্টা আগে বিভিন্ন সময়ে প্রবল আঘাতের দরুন।
ভূষণ পুলিশি হাজতে ছিলেন ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে। লালবাজারের কিছু পুলিশকর্তা জানাচ্ছেন, হাজতে মারধরের জেরেই যে ওই যুবকের মৃত্যু হয়েছে, ময়না-তদন্তের রিপোর্টে সেটা পরিষ্কার। এর প্রাথমিক দায় বর্তায় ঘটনার সময়ে ওই লক-আপের দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মী এবং তদন্তকারী অফিসারের উপরে।
থানার লক-আপে বেদম মারধরের ফলেই যে ভূষণের মৃত্যু হয়েছে, সরকারি ভাবে লালবাজারের তরফে এখনও অবশ্য তা অস্বীকার করা হচ্ছে। বরং তাদের দাবি, ভূষণের মৃত্যুর কারণ তাঁর অসুস্থতাই।
ঘটনার তদন্তের গতিপ্রকৃতি উল্লেখ করে লালবাজারের এই দাবির প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা চলেছে সমানে। শুধু মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না পুলিশ। ময়না-তদন্তের রিপোর্টে সুস্পষ্ট ভাবে প্রহারের দরুন মৃত্যুর কথা বলা হলেও সংশ্লিষ্ট থানার অভিযুক্ত কর্মী-অফিসারদের বিরুদ্ধে খুনের ধারার বদলে তুলনায় লঘু ৩০৪ ধারায় অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, ময়না-তদন্তে কয়েক দিন ধরে বেদম পেটানোর প্রমাণ মিললেও অভিযুক্ত কর্মী-অফিসারদের বিরুদ্ধে এমন লঘু ধারা কেন? সত্য সন্ধানে লালবাজারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন পুলিশের কিছু কর্তাও। এমনই এক পুলিশকর্তা জানন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশিকা অনুযায়ী থানার লক-আপে থাকাকালীন কোনও অভিযুক্তের দেহে যদি গভীর ক্ষত মেলে এবং ময়না-তদন্তের রিপোর্ট যদি বলে যে, ওই ক্ষতের
কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে, তা হলে সংশ্লিষ্ট অফিসারের বিরুদ্ধে সরাসরি খুনের অভিযোগ (৩০২ ধারা) দায়ের করে তদন্ত শুরু করার কথা। ‘‘কিন্তু এ ক্ষেত্রে তো গোড়াতেই গলদ,’’বলছেন পুলিশের ওই কর্তা।
গলদ ঢাকার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় ২৮ সেপ্টেম্বর ময়না-তদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পরেই। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার (হোমিসাইড) অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় বড়তলা থানায় যান। তদন্তের দায়িত্ব প্রথমে দেওয়া হয়েছিল বড়তলা থানারই অতিরিক্ত অফিসার ইনচার্জকে। পরে পুলিশেরই ঘরে-বাইরে হাজারো প্রশ্ন আর বিতর্কের মুখে পড়ে তদন্তের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার হাতে।
শব ব্যবচ্ছেদের আগে থেকেই ভূষণের পরিবার অবশ্য তাঁর মৃত্যুর জন্য সরাসরি পুলিশকে দায়ী করে আসছে। ময়না-তদন্তের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরে মহারাষ্ট্রের সাতারা থেকে কলকাতায় এসে সরাসরি পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে মনস্থ করেছেন ভূষণের কাকা বিশভরাও দেশমুখ। বিষয়টি নিয়ে মানবাধিকার কমিশনের দ্বারস্থও হতে চান তিনি। সাতারা থেকে ফোনে বিশভরাও বলেন, ‘‘আমার ভাইপো কাজের সূত্রে ১০ বছর ধরে কলকাতার বাসিন্দা। কোনও দিনই ও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। যদি ধরে নিই সে অপরাধী, তা হলেও তাকে লক-আপে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার নেই পুলিশের।’’
বিশভরাওয়ের অভিযোগ, পুলিশ জানিয়েছিল পেটের গোলমাল এবং বমির জেরে ভূষণের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তির সময় দেখানো হয়েছে ২৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা ৩২ মিনিট। আর মৃত্যুর সময় লেখা হয়েছে ১০টা ৫০ মিনিট। ‘‘পেটের গোলমাল আর বমির জন্য মাত্র ১৮ মিনিটে কেউ মরে যেতে পারে না,’’ বলছেন বিশভরাও। তাঁর দাবি, শেষকৃত্যের সময় তাঁরা ভূষণের হাঁটু, কনুই আর পিঠে বেশ কয়েকটি গভীর ক্ষত দেখেছেন।
ভূষণের কাকার বক্তব্যের সমর্থন মিলেছে ময়না-তদন্তের রিপোর্টে। ওই রিপোর্ট বলছে: ভূষণের দুই হাঁটু, ঊরু, গোড়ালি, পায়ের পাতায় গভীর ক্ষত ছিল। আঘাতের চিহ্ন ছিল ডান পায়ের কাফ পেশিতে। মারধরের প্রমাণ আছে দুই কাঁধে, শিরদাঁড়াতেও। প্রচণ্ড মারধরের ফলে ভূষণের ডান দিকের কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আঘাত লেগেছিল মাথার পিছন দিকেও। এবং ওই সব ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল ভূষণের মৃত্যুর দু’-এক দিন আগেই।
১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘটনা পরম্পরা, ভূষণের পরিবারের দাবি ও অভিযোগ এবং সর্বোপরি ময়না-তদন্তের রিপোর্ট— তিন দিক থেকেই পুলিশ বেকায়দায়। পুলিশি সূত্রের খবর, ১৯ সেপ্টেম্বর বড়তলা থানার পুলিশ দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট থেকে ভূষণকে এবং তাঁর বন্ধু নিরঞ্জন দোপ্টেকে আটক করে। পরের দিন সকালে নিরঞ্জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বেআইনি অস্ত্র আইনে গ্রেফতার করা হয় ভূষণকে। আদালতে তোলা হলে বিচারক তাঁকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশি হাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
কিন্তু সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই, ২৫ তারিখ সকালে আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়েন ভূষণ। তাঁকে আর জি কর হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয় পুলিশ। তাদের দাবি, সেখানেই কিছু ক্ষণের মধ্যে মৃত্যু হয় ভূষণের।
পেটের অসুখে ভূষণের মৃত্যু হয়েছে বলে তাঁর বাড়িতে খবর দেয় বড়তলা থানা। পরিবারের দাবি, মৃত্যুর আগের দিন, ২৪ সেপ্টেম্বর বিকেলেও ভূষণের সঙ্গে তাঁদের ফোনে কথা হয়েছে। থানার এক অফিসারই কথা বলিয়ে দিয়েছিলেন। তখনও পর্যন্ত ভূষণ নিজে কিংবা থানা থেকে কেউ তাঁর কোনও রকম অসুস্থতার কথা জানাননি। ভূষণের সঙ্গে কথা বলেও তাঁকে অসুস্থ মনে হয়নি আত্মীয়স্বজনদের। তাই প্রশ্ন উঠছে, ওই যুবকের পেটে হঠাৎ কী এমন সমস্যা হতে পারে যে, হাসপাতালে ভর্তির ১৮ মিনিটের (আর জি করে ভূষণকে ভর্তি করানো হয় ২৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা ৩২ মিনিটে। তাঁর মৃত্যু হয় ১০টা ৫০ মিনিটে) মধ্যে মৃত্যু ঘনিয়ে এল?
ময়না-তদন্তের রিপোর্ট মারধরে অজস্র ক্ষতের কথা জানানোয় পেটের অসুখের কথাটা আর ধোপে টিকছে না বলে জানাচ্ছে পুলিশেরই একটি অংশ। লালবাজারের একটি সূত্র জানাচ্ছে, পুলিশ অস্ত্র আইনে মামলা দিলেও ভূষণের বিরুদ্ধে উপযুক্ত কোনও তথ্যপ্রমাণ পায়নি। মামলা দাঁড় করানোর তাগিদেই তাঁকে হেফাজতে রেখে জেরা চালিয়ে যাওয়া হয়। ভূষণের পরিবারের সন্দেহ, অবৈধ অস্ত্রের বিষয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্যই তাঁকে বেধড়ক মারধর করেছে পুলিশ। এবং তাতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের এই অভিযোগকে পুষ্ট করছে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট। সেই রিপোর্টকে আঁকড়ে ধরেই সুবিচার পেতে কোমর বাঁধছে ওই মরাঠি যুবকের পরিবার।