সইফুদ্দিন লস্কর। —ফাইল চিত্র।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরে তৃণমূল নেতা খুনের ঘটনায় প্রাথমিক ভাবে ‘রাজনীতি যোগের গন্ধ’ই পাচ্ছিলেন তদন্তকারীরা। তৃণমূল নেতৃত্ব এবং স্থানীয়দের বয়ানেই সেই তত্ত্ব জোরালো হচ্ছিল। কিন্তু একমাত্র ধৃতকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মঙ্গলবার যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে তদন্তের গতিপ্রকৃতি অনেকটাই বদলে গিয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীদের একাংশ। ওই অংশের মত, ধৃত জেরায় ধৃত যে বয়ান দিয়েছেন, তাতে শাসকদলের নেতা খুনে প্রকট হচ্ছে ‘প্রতিশোধের’ তত্ত্ব!
সোমবার সকালে বামনগাছি পঞ্চায়েতের বাঙালবুড়ির মোড়ে নমাজ পড়তে যাওয়ার সময় খুন হন সইফুদ্দিন। মসজিদের সিঁড়িতে সবে পা রেখেছিলেন তিনি, এমন সময়ে তাঁর ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে পালায় দুষ্কৃতীরা। কিন্তু পালানোর সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ায় দু’জন ধরা পড়ে যান স্থানীয়দের হাতে। অভিযোগ, সাহাবুদ্দিন নামে তাঁদের এক জনকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। অন্য জন, শাহরুল শেখকে জখম অবস্থায় উদ্ধার করে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নিরাপত্তার কারণে তাঁকে বারুইপুর থানায় রাখা হয়েছিল। শাহরুলকে মঙ্গলবার বারুইপুর মহকুমা আদালতে হাজির করানো হয়। আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশকর্মীরা যখন তাঁকে গাড়িতে তুলছিলেন, সেই সময় শাহরুল দাবি করেন, তিনি গুলি চালাননি। ‘বড়ভাই’ নাসির ‘টিপ’ দিয়েছিলেন!
আদালতে শাহরুলের হয়ে কোনও আইনজীবীই সওয়াল করেননি। বিচারক ধৃতকে ১০ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। লকআপে যাতে তাঁর উপর কোনও অত্যাচার না হয়, তা-ও নিশ্চিত করতে বলেছেন বিচারক। আদালত থেকে বেরোনোর সময় শাহরুলকে আবার বলতে শোনা যায়, ‘‘নাসির খুন করার অর্ডার দিয়েছিলেন।’’ কিন্তু কে সেই নাসির? সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শাহরুল শুধু বলেন, ‘‘বড়ভাই।’’ কার বড়ভাই, তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি তিনি। বার বার শুধু বলছিলেন, ‘‘গুলি আমি চালাইনি।’’
পুলিশ সূত্রে খবর, শাহরুলের বয়ান ধরে এখন এই ‘বড়ভাই’ নাসিরেরই খোঁজ চলছে। মঙ্গলবার রাতে এ নিয়ে বৈঠকও করেছেন বারুইপুর পুলিশ জেলার আধিকারিকেরা। তদন্তকারীদের একটি সূত্রের দাবি, নাসিরের সম্ভাব্য যে ঠিকানা শাহরুল দিয়েছেন, সংগ্রামপুর সংলগ্ন টেকপাঁজায় রাতেই অভিযান চালানো হতে পারে। যদিও পুলিশের তরফে এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে কিছুই জানানো হয়নি।
তদন্তকারীদের ওই অংশটির সূত্রে জানা গিয়েছে, জেরায় শাহরুল জানিয়েছেন, তিনি ডায়মন্ড হারবারের নেতড়ার বাসিন্দা। পেশায় দর্জি হলেও বিভিন্ন সময়ে ছোটখাটো চুরি-ছিনতাইও করেছেন। পুলিশের খাতায় আগেও তাঁর নাম উঠেছে। সেলাইয়ের কাজের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে জয়নগরের গোদাবর এলাকার বাসিন্দা সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। তদন্তকারীদের চাপের মুখে শাহরুল জানিয়েছেন, ‘চুরির কাজ’ আছে জানিয়ে সম্প্রতি তাঁকে জয়নগরের বামনগাছিতে নিয়ে আসেন নাসিরই। ধৃত স্বীকার করেছেন, বামনগাছিতে সইফুদ্দিনের প্রাসাদোপম বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে কয়েক দিন ধরেই থাকছিলেন তিনি। ওই বাড়ির উপর তাঁকে নজর রাখতে বলা হয়েছিল। শাহরুলই খবর দিতেন, গৃহকর্তা সইফুদ্দিন কখন কোথায় যান। সকালে মসজিদে নমাজ পড়তে যাওয়ার খবর তিনিই দিয়েছিলেন। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই খুনের ছক কষা হয় বলে জেরায় দাবি করেছেন শাহরুল।
সইফুদ্দিনকে খুনের মুহূর্তের একটি সিসিটিভি ভিডিয়ো মঙ্গলবার প্রকাশ্যে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল নেতা ধীরেসুস্থে হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে। আচমকা তাঁর পাশ ঘেঁষে দু’টি মোটরবাইক এসে দাঁড়ায়। তার পরের দৃশ্য আর দেখা যায়নি। এর পরেই সেখানে ছুটে আসেন স্থানীয় কয়েক জন বাসিন্দা। তত ক্ষণে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন সইফুদ্দিন। স্থানীয় সূত্রে খবর, পরে তাঁকে পদ্মেররহাট গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। পুলিশ সূত্রেই খবর, জেরায় শাহরুল দাবি করেছেন, খুনের সময় তিনি ছিলেন ঘটনাস্থলে। কিন্তু তিনি গুলি চালাননি। চালিয়েছেন সাহাবুদ্দিন। যদিও মৃত সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী জরিনা বিবির দাবি, তাঁর স্বামী এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নন। মৃতের মেয়ে রুবিয়ার কথায়, ‘‘আইন-আদালত থাকা সত্ত্বেও কেন এক জনকে এ ভাবে পিটিয়ে মারা হল! আমরা বিচার চাই।’’
রাজনৈতিক সন্ত্রাস-সহ অপরাধমূলক কাজকর্মে এক সময়ে রাজ্যে প্রথম সারিতে ছিল জয়নগর, কুলতলি ও আশপাশের এলাকা। তবে, গত কয়েক বছরে এলাকায় সে ভাবে বড় ঘটনা ঘটেনি। বামনগাছির তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিন খুন ও পরবর্তী উত্তেজনা ঘিরে সেই সন্ত্রাসের পরিবেশ ফিরছে বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়দের একাংশ। সোমবার যে ভাবে কাছ থেকে গুলি করে সইফুদ্দিনকে খুন করা হয়েছে এবং পরে যে কায়দায় পাশের গ্রাম দলুইখাকিতে প্রায় ১৫টি বাড়ি পোড়ানো হয়েছে, তা নজিরবিহীন বলেই মনে করছেন এলাকার লোকজন।
তৃণমূল নেতা খুনে প্রাথমিক ভাবে রাজনৈতিক যোগসাজশের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছিল। তৃণমূল দাবি করেছিল, এটা সিপিএমের কাজ। স্থানীয় সূত্রের খবর, এলাকার এক সিপিএম নেতার সঙ্গে বিবাদ ছিল সইফুদ্দিনের। তা ছাড়া, বামনগাছি পঞ্চায়েতের দুর্নীতি নিয়ে আদালতে গিয়েছিলেন সিপিএমের কিছু স্থানীয় নেতা। তার জেরে সম্প্রতি আদালতের নির্দেশে জেলাশাসক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে প্রতিনিধি দল পাঠান। তা নিয়ে দু’পক্ষের চাপানউতর চলে। তা ছাড়া, সইফুদ্দিনের হাত ধরে বহু সিপিএম কর্মী-সমর্থক তৃণমূলে এসেছিলেন। তৃণমূলের দাবি, তাঁর জনপ্রিয়তায় কার্যত মুছে যাচ্ছিল সিপিএম। সেই কারণেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়। সিপিএম অবশ্য সেই অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে।
কিন্তু তদন্ত যত এগিয়েছে, তত রাজনীতির যোগের বিষয়টি ক্ষীণ হয়েছে। জোরালো হয়েছে প্রতিশোধের তত্ত্ব! তদন্তকারীদের ওই অংশটির দাবি, শাহরুল জেরায় জানিয়েছেন, তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। সইফুদ্দিনের সঙ্গে কয়েক জন অভিযুক্তের পূর্বপরিচিতি ছিল। তাঁদের মধ্যে নাসিরও রয়েছেন। তৃণমূল নেতা তাঁদের বিভিন্ন সময় ফৌজদারি মামলায় ফাঁসিয়েছেন। সেই কারণেই সইফুদ্দিনের উপর চাপা রাগ ছিল নাসিরদের। বদলার মনোভাব থেকেই সইফুদ্দিনকে খুন হয়েছে বলে ধৃতের বয়ানের ভিত্তিতে প্রাথমিক ভাবে মনে করছেন তদন্তকারীদের একাংশ।
পুলিশকে ‘ডেডলাইন’ সুজনদের
সোমবার সইফুদ্দিন খুন হওয়ার পরেই জ্বলে উঠেছিল জয়নগরের দলুইখাকি। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গ্রামের একের পর এক বাড়িঘর, দোকানপাট! অভিযোগ, বেছে বেছে সিপিএম নেতা-কর্মীদের বাড়িতেই হামলা চালানো হয়েছে। তার পর থেকেই গোটা গ্রাম পুরুষশূন্য। আতঙ্কে সোমবার রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি বাড়ির মহিলারা। সকালেও গোটা গ্রাম নিস্তব্ধ। ভোরের আলো ফুটতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন অনেকে। মঙ্গলবার তাঁদের নিয়েই জয়নগর থানায় যান সিপিএম নেতারা। অবিলম্বে যদি ঘরছাড়াদের গ্রামে না ফেরানো হয়, তা হলে তাঁরাই সেই ব্যবস্থা করবেন বলে হুঁশিয়ারি দিলেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘‘সাত-আট দিন, সব মিলিয়ে ২২ তারিখ (নভেম্বর) পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। ওঁদের গ্রামে ফেরানোর ব্যবস্থা না করা হলে আমরা বুঝিয়ে দেব। সব শক্তি নিয়ে এখানে আসব।’’ দলুইখাকির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে মঙ্গলবার সেখানে যান সিপিএমের প্রতিনিধি দল। ওই দলে সুজন ছাড়াও ছিলেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়।
পুলিশের বাধা
কিন্তু দলুইখাকিতে ঢোকার আগেই বামনগাছিতে তাঁদের আটকে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। বাধা পেয়ে পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়াতে দেখা গিয়েছে সিপিএম নেতাদের। প্রকাশ্যে আসা একটি ভিডিয়ো ফুটেজে এক পুলিশ আধিকারিককে ধাক্কা দিতে দেখা গিয়েছে সুজনকে। ওই ভিডিয়োর সত্যতা যদিও আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করেনি। এর পরেই ঘরছাড়াদের নিয়ে জয়নগর থানায় যান সুজনেরা। সিপিএম নেতারা জানান, আপাতত থানাতেই তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দলের তরফে ঘরছাড়াদের জন্য হাঁড়ি-কড়াই, মশারি, কম্বল দেওয়া হয়েছে। কিছু দিন সেখানে থেকে খাওয়াদাওয়ার জন্য আর যা যা জিনিস প্রয়োজনীয়, তা-ও দেওয়া হবে জানিয়েছেন সিপিএম নেতারা। ঘরছাড়াদের উদ্দেশে সুজন বলেন, ‘‘আপনারা কয়েক দিন এখানে থাকুন। আমরা সেই ব্যবস্থা করে দিয়ে যাচ্ছি। কয়েক দিন থাকার জন্য যা যা লাগবে, বুধবারের মধ্যে দেওয়ার চেষ্টা করছি। কেউ যদি বাড়ি ফিরতে চান, অবশ্যই ফিরতে পারেন।’’ এর পরেই পুলিশের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দেন সুজন। তিনি বলেন, ‘‘দু’-এক দিনের মধ্যে আবার আসব। খোঁজ নিয়ে যাব। এক সপ্তাহের মধ্যে যদি এঁদের ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা না করা হয়, তা হলে সব শক্তি নিয়ে এখানে আসব।’’ সিপিএমের দাবি, দলুয়াখাকি তৃণমূলের কব্জায় নেই। সেই কারণেই সোমবার ওই গ্রামে হামলা চালানো হয়েছে।
শিশুদের জন্য নওশাদের খাবার
দলুইখাকি যেতে গিয়ে বাধা পান ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকিও। তাঁকে গোচরণে আটকে দেয় পুলিশ। পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে বচসায় জড়াতে দেখা গিয়েছে নওশাদকেও। কিসের ভিত্তিতে তাঁকে আটকান হচ্ছে, তা পুলিশের কাছে জানতে চান বিধায়ক। কিন্তু পুলিশের তরফে তাঁকে কোনও নথি দেখানো হয়নি। আইএসএফ সূত্রে খবর, দলুইখাকির শিশুদের জন্য নওশাদ খাবার নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পুলিশের বাধা পেয়ে সেই খাবার শেষমেশ বারুইপুরের এসডিপিও অতীশ বিশ্বাসের হাতে তিনি তুলে দিয়েছেন। তা যাতে গ্রামের বাচ্চারা খেতে পারে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও এস়ডিপিও-কে দিয়েছেন বিধায়ক। পুলিশ প্রশাসনের অবশ্য বক্তব্য, এলাকার আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই নওশাদ ও সিপিএম নেতাদের দলুয়াখাকি যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে।
শওকতকে হুমকি-ফোন
তৃণমূল নেতা খুন নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যেই মঙ্গলবার তাঁকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করলেন শাসকদলের নেতা তথা ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক শওকত মোল্লা। বিধায়কদের দাবি, সকাল ১০টা নাগাদ ভাঙ়ড়ের পথে যাওয়ার সময় তাঁর হুমকি ফোন এসেছিল। যে নম্বর থেকে ফোনটি এসেছিল বলে দাবি করেছেন বিধায়ক, সেটিও প্রকাশ্যে আনেন তিনি। শওকত বলেন, ‘‘আমাকে ফোন করে বলা হয়েছে, ‘গত কাল খুন করেছিল। তোকেও খুন করে দেব। তুই তৈরি থাকিস।’ আর সেই সঙ্গে কদর্য ভাষায় গালিগালাজ চলছিল। আমাকে বলেছে, হয় ক্যানিংয়ে নয়তো ভাঙড়ে খুন করবে।’’ হুমকি-ফোনের পিছনে বিরোধী দলেরই কেউ রয়েছেন বলে দাবি করেছেন শওকত। তিনি বলেন, ‘‘আমি শহিদ হতে ভয় পাই না। এক বার কেন, একশো বার মারলেও কিছু যায় আসে না।’’ তার পাল্টা নওশাদ সিদ্দিকি পাল্টা বলেন, ‘‘যিনি খুনের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন, তিনি তো শাসকদলের বিধায়ক। তাঁর দল ক্ষমতায় রয়েছে। তার পরেও তাঁকে খুনে হুমকি দেওয়ার সাহস হয় কী করে? পুলিশ প্রশাসন কী করছে? বগটুইকাণ্ডের পর বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশ প্রশাসন সেই কাজ যদি করতে পারত, তা হলে এই ঘটনা ঘটত না।’’