অনেকটা এমনই দেখতে হয় পেন পিস্তল।
জেমস বন্ড থেকে মধ্যমগ্রামের বাবু সেন। হলিউ়ডের ‘নেভার সে নেভার এগেন’ থেকে উত্তর ২৪ পরগনার বাদুর অস্ত্র-কারখানা। পেন পিস্তল নামে মারণাস্ত্র অতিক্রম করেছে ভৌগোলিক দূরত্ব, মুছে দিয়েছে কল্পনা ও বাস্তবের ব্যবধান।
গত ৭ মে মধ্যমগ্রামে দুষ্কৃতীদের গুলিতে এক সহযোগী-সহ ঝাঁঝরা হওয়া বাবু সেনের হত্যার তদন্তে নেমে খাস কলকাতার অদূরেই কারখানায় পেন পিস্তলের তৈরি হত বলে জেনেছে পুলিশ। যে কারখানার মাথা ছিল খোদ বাবু সেন-ই।
পুলিশ জানাচ্ছে, জমি কেনাবেচা করত বলে বাবু সেনকে যেমন ‘মাটি-বাবু’ ডাকা হত, তেমনই তার অস্ত্র কারখানায় তৈরি পেন পিস্তলের চাহিদা থাকায় তার অন্য নাম ছিল ‘পেন-বাবু’। ফোনে দশ পিস পেন আর পঞ্চাশটা রিফিল চাই বললেই মিলে যেত দশটি পেন পিস্তল আর পঞ্চাশটি গুলি। একটি পেন পিস্তলের দাম পড়ত দেড় হাজার আর গুলি মিলত দেড়শো টাকা করে। মধ্যমগ্রাম ছাড়াও বিমানবন্দর ও রাজারহাটের প্রত্যন্ত এলাকার কারখানায় তৈরি হত পেন পিস্তল বা পেনগান।
পেন পিস্তলের ব্যবহার এ দেশে সাম্প্রতিক কালে করেছিল আলফা, এনডিএফবি-র মতো উত্তর-পূর্বের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি এবং পরে মাওবাদীরা। কিন্তু সাধারণ দুষ্কৃতীরাও যে পেন পিস্তল ব্যবহার করছে, বাবু সেন হত্যার তদন্ত সে দিকটাই উন্মোচিত করল বলছে পুলিশ।
উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় জানান, প্রথমে বিহারের মুঙ্গেরের এজেন্টদের থেকে অস্ত্র কিনে এ রাজ্যের সরবরাহ করত বাবু সেন। পরে সে নিজেই অস্ত্র কারখানা খুলে বসে। ভাস্করবাবুর কথায়, ‘‘বাবুর তৈরি অস্ত্রের মধ্যে সব চেয়ে জনপ্রিয় হয়েছি ল পেন পিস্তল। এমনকী, বাবুকে খুনের অভিযোগে ধৃতদের একাংশও তা স্বীকারও করেছে।’’
কেমন দেখতে এই পেন পিস্তল?
পুলিশ জানিয়েছে, অবিকল কলমের মতো দেখতে অস্ত্রটি জামার পকেটে রেখে যে ক্লিপের সঙ্গে আটকাতে হয়, সেই ক্লিপই আসলে ট্রিগার। সেটি টিপলে গুলি বেরোবে পেনের মুখ থেকে। লক্ষ্যের খুব কাছে গিয়ে পেন পিস্তল থেকে গুলি ছুঁড়লে তবেই ফল হয় মারাত্মক। অস্ত্রটি নিয়ে ফাঁকি দিয়ে ভিআইপি-র নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঢুকে পড়াও সহজ হয়।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য ভিআইপি-র নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পেন পিস্তলের মতো হাতিয়ার থেকে বিপদের ঝুঁকি সব সময়েই পুলিশ ও গোয়েন্দাদের উদ্বেগের কারণ। আর মধ্যমগ্রাম কাণ্ডে পেন পিস্তলের প্রসঙ্গ উঠে আসায় রাজ্যের স্পেশ্যাল সিকিওরিটি উইং (এসএসডব্লিউ) এই ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ নিচ্ছে। এর জন্য মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বলয়ে কোনও বদল আনা হবে কি না, সেই ব্যাপারেও চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৯-এর জানুয়ারিতে বাগুইআটিতে এক অস্ত্র ভাণ্ডার থেকে তিনটি পেন পিস্তল উদ্ধার করে সিআইডি। তারপরে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়। তাঁর সুরক্ষায় আনা হয় ‘বডি স্ক্যানার’। যা মামুলি জিনিসের ভেক ধরে থাকা হাতিয়ারকেও খুঁজে বিপদসঙ্কেত দেবে। বাগুইআটির ধৃত অস্ত্র কারবারিরা জানিয়েছিল, এ রাজ্যের কাঁথি এবং ছত্তীসগঢ়ের মাওবাদীদের কাছে পেন পিস্তল বিক্রি করা হয়েছে।
তদন্তকারীরা জানান, নিজে অস্ত্র কারখানা গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বাবু সেন বিহারের মুঙ্গের থেকে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির এক কারিগরকে নিয়ে আসে। সে-ই প্রচুর পেনগান তৈরি করেছিল।
সেলুলয়েডের পর্দায় এই পেন পিস্তল দিয়েই জিরো জিরো সেভেন-এর ভূমিকায় শন কনারি নিজেকে রক্ষা করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে ভারতে গুপ্তঘাতকদের হাত থেকে বাঁচাতে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে একটি পেন পিস্তল উপহার দেন যোধপুরের মহারাজা। সম্প্রতি লন্ডনে ওই পেন পিস্তল বিশাল দামে নিলাম হয়েছে।