উদ্ধার হওয়া ৭.২ এমএম পিস্তল। — নিজস্ব চিত্র।
৯-এর চেয়ে ৭.২ বেশি।
ধাঁধা লাগানো মতো এই পাটিগণিত কপালে ভাঁজ ফেলেছে পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের। রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ-কর্তার দাবি, পুরভোটের আগে থেকে শুরু করে ভোট-পর্ব মেটা পর্যন্ত গত মাস কয়েকে যে সব বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে সংখ্যার বিচারে ৯ মিলিমিটার (এমএম) পিস্তলের চেয়ে বেশি মিলেছে ৭.২ এমএম পিস্তল। এমনকী, গিরিশ পার্কে পুলিশ অফিসারের উপরে গুলি চালনায় মূল অভিযুক্ত গোপাল তিওয়ারির বাড়ির অস্ত্রাগার থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যেও ৭.২ এমএম দু’টি, ৯ এমএম একটি।
দীর্ঘকাল ধরেই সমাজবিরোধীদের একটা বড় অংশ ‘ওয়ানশটার’ (পাইপগান) ব্যবহার করে। তার কারণ দাম কম (আড়াই থেকে পাঁচ হাজার টাকা)। গুলিও মেলে কম দামে। খুব কাছ থেকে ব্যবহার করলে প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই প্রাণঘাতী এই আগ্নেয়াস্ত্র। তবে সমস্যাও রয়েছে। মাঝেমধ্যেই ব্যারেলের মধ্যে এক-আধটা গুলি ফেটে গিয়ে চোট লাগে হাতে। পাকা হাতে না পড়লে গুলি বেরনোর ঝাঁকুনিতে পাইপগান কেঁপে রামের বদলে শ্যামও মারা পড়তে পারে। তা ছাড়া, গুলি ভরার ক্ষেত্রে এবং পর পর গুলি চালালে তেতে ওঠার সমস্যাও আছে।
এই জায়গা থেকেই নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে বাজারে আসতে শুরু করে ৯ এমএম। প্রথমে চিন থেকে চোরা পথে, পরে মুঙ্গের থেকে। ওই পিস্তলের সুবিধা ছিল— পাল্লা প্রায় ২০০ মিটার, ম্যাগাজিনে ১০-১২টি গুলি ধরে, মারণক্ষমতা ১০ মিটারের মধ্যে মারাত্মক। ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটের আগে পর্যন্ত সমাজবিরোধীদের মধ্যে তুলনায় সঙ্গতিসম্পন্ন ‘দাদা’রা তাই ভরসা রাখছিলেন ৯ এমএম-এই।
‘পরিবর্তন’ এল পঞ্চায়েত ভোটের সময়। বেআইনি অস্ত্রের বাজারে ঢুকল মুঙ্গেরে তৈরি ৭.২ এমএম। এক পুলিশ-কর্তা জানাচ্ছেন, দেশে-বিদেশে বন্দুক ব্যবসায় ৭.২ এমএম পিস্তল প্রচলিত নয়। কিন্তু মুঙ্গেরের এই পিস্তলটিকে চিনতে সুবিধার জন্য তাঁরা ৭.২ এমএম বলছেন। তবে এতে সাধারণত .৩২ পিস্তলের গুলি ব্যবহার করা হয়। তার পরেই ওই পুলিশ-কর্তা চলে যাচ্ছেন ৯ এমএমের সঙ্গে তুলনায়। দেশি ৯-এমএম পিস্তল যেখানে খালি অবস্থায় এক কিলো এবং গুলি ভর্তি অবস্থায় ১,৪০০ গ্রাম ওজন, সেখানে এই পিস্তল খালি অবস্থায় ৭০০ গ্রাম, ভরা অবস্থায় এক কিলো ওজনের। চোরাবাজারে বেলজিয়াম বা ইটালিতে তৈরি ৯ এমএমের দাম যেখানে দেড় থেকে আড়াই লক্ষ টাকা, চিনা ৯-এমএম যেখানে ৭০ হাজার, দেশি ৯ এমএম ৫০-৬০ হাজারে বিকোয়, ৭.২ এমএম সেখানে মিলতে শুরু করে ২৪-৩০ হাজার টাকায়।
পুলিশ সূত্রের দাবি, উদ্ধার হওয়া দু’ধরনের পিস্তল চালিয়ে দেখা গিয়েছে, পাল্লা এবং মারণক্ষমতা প্রায় সমান। ৭.২ এমএম এগিয়ে রয়েছে গুলি বেরনোর ঝাঁকুনি (রিকয়েল) এবং আওয়াজ কম হওয়ায়।
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা জানিয়েছেন, প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং দামের আকর্ষণে দুষ্কৃতীদের একটা বড় অংশ ৭.২ এমএম পিস্তল কিনতে শুরু করে। পুরভোটের আগে ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়াতে আকর্ষণীয় ‘অফার’ দিকে শুরু করে মুঙ্গেরের অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। আগে পিস্তল কিনলে দশ গুলির ‘ম্যাগাজিন’ বিনামূল্যে পাওয়া যেত। পুরভোটের আগে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় পিস্তল কিনলে দু’টি গুলিভর্তি ম্যাগাজিন মিলবে মুফতে। ফলে, ৭.২ এমএমের কাটতি বেড়েছে অনেকটাই।
পুলিশ সূত্রের খবর, মুঙ্গের থেকে ট্রেন ও সড়ক পথে দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গে পাচার করা হচ্ছে ওই অস্ত্র। বেশ কয়েকজন স্থানীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীকে জেরা করে নির্দিষ্ট ট্রেন ও রাস্তায় নজরদারি করে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তার পরেও পুরভোটের আগে, ভোটের দিন এবং ভোটের পরে উত্তর ২৪ পরগনার গয়েশপুর থেকে হুগলির বাঁশবেড়িয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা থেকে বর্ধমানের কাটোয়ায় ৭.২ এমএম পিস্তল হাতে দুষ্কৃতীরা দাপিয়েছে।
দুষ্কৃতীদের হাতে ৭.২ এমএমের আধিক্য যে তাঁদের চিন্তায় ফেলেছে মেনে নিচ্ছেন রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা। বলছেন, ‘‘গত ছ’মাসে রাজ্যে প্রায় হাজার দু’য়েক বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। তার মধ্যে ৭.২ এমএমের সংখ্যা উদ্বেগজনক। রাজ্য গোয়েন্দা দফতর-সহ বিভিন্ন থানাকে বিশেষ ভাবে সতর্ক করেছি। বিশেষ তল্লাশি অভিযানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’
পুলিশের তল্লাশি চললেও সমাজবিরোধীরা যে বসে থাকবে না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন দক্ষিণ শহরতলির তিলজলা এলাকায় সম্প্রতি ঘুরে যাওয়া মুঙ্গেরের এক অস্ত্র ব্যবসায়ী। বলেছেন, ‘‘ভাল জিনিস বাজারে থাকলে, কেনার লোকের অভাব নেই।’’