পাতা উল্টে দেখছে পুলিশ।
খতিয়ে দেখা হচ্ছে, কোন থানায় এর আগে কোন কোন নেতা-নেত্রীর নামে জোর করে টাকা চাওয়া বা টাকা নেওয়ার কত অভিযোগ জমা পড়েছে।
ফলে, তোলাবাজির অভিযোগে বিধাননগরের কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ার পরে আপাতত ‘চুপচাপ’ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েও স্বস্তিতে নেই বিধাননগর, রাজারহাট, বাগুইআটি এলাকার শাসক দলের নেতা-নেত্রীরা। বিধাননগর পুরসভার অলিন্দে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, এ রকম নেতা-নেত্রীর সংখ্যা প্রায় ১৪-১৫। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ গত ১০-১৫ বছর ধরে কাউন্সিলর। প্রথম বার ভোটে জিতে আসার পর থেকেই ছোটখাটো তোলাবাজির অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিল তাঁদের নামে। কিন্তু ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ওই কাউন্সিলরদের দাপট বহু গুণ বেড়ে যায়। অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ীরা। তোলাবাজিতে জেরবার হয়ে তাঁরা ওই সব কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে থানায় কোনও নালিশ করেছিলেন কি না, তা-ই এখন খুঁজে দেখছে পুলিশ।
বিধাননগর কমিশনারেটের এক কর্তা জানাচ্ছেন, তদন্তের প্রথম ধাপ হিসেবে যে সব শাগরেদের মাধ্যমে নেতা-নেত্রীরা তোলাবাজির চক্র চালান, তাদের খোঁজ চলছে। বৃহস্পতিবারেই অনিন্দ্যর দুই শাগরেদকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কিন্তু এই তৎপরতা কত দিন চলবে? বিধাননগরের বাসিন্দাদের একাংশের আশঙ্কা, অতীতে অনেক সময় অভিযোগ পেয়েও পুলিশ নড়ে বসেনি। এ বারও হয়তো কিছু দিন নাড়াচাড়ার পরে সব ধামাচাপা পড়ে যাবে। যদিও বিধাননগর পুলিশের ওই কর্তার দাবি, ‘‘এটা এখন চলবে। কেউ যদি ধরে নেন যে দু’মাস অভিযান চালানোর পরে পুলিশ ঢিলে দিয়ে দেবে, তা হলে ভুল করবেন।’’ জানা গিয়েছে, এমনই সুস্পষ্ট নির্দেশ এসেছে নবান্নের শীর্ষ স্তর থেকে।
ফলে বিধাননগরের তোলাবাজ নেতা-নেত্রীরা যে বেশ চাপে পড়েছেন, তার খবরও আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন মহল থেকে। অনিন্দ্যর মতো বিধাননগরের অন্য এক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধেও টাকা দাবি করে এক বাসিন্দার বাড়ির কাজ আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছিল। অনিন্দ্যর গ্রেফতারের পরে তিনি নাকি সেই বাসিন্দাকে ডেকে বলেছেন, কাজ করে নিন, টাকা লাগবে না।
শাসক দলের এক কাউন্সিলরের কথায়, ‘‘খেতে খেতে অনিন্দ্যর হুঁশ ছিল না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোক এবং এক প্রাক্তন দাপুটে কংগ্রেসি নেতার কাছ থেকেও টাকা চেয়ে বসেছিল।’’ অনিন্দ্যর মতো বেলাগাম না-হয়ে, আপাতত রয়েসয়ে, দেখেশুনে টাকা খাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৃণমূল কাউন্সিলররা। কেউ কেউ শাগরেদদের স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, খোলামেলা টাকা তোলা এখন বন্ধ রাখতে হবে। এলাকার হোটেল, দোকান থেকে নিয়মিত যে টাকা আসত, তা হয়তো বন্ধ হবে না। তবে, কেউ টাকা দিতে আপত্তি জানালে তা নিয়ে যেন বাড়াবাড়ি করা না হয়। মোটরবাইক আরোহী, কাউন্সিলর-ঘনিষ্ঠ যে যুবকদের সম্প্রতি বিধাননগরে ঘুরতে দেখা যাচ্ছিল, তাঁদেরও আপাতত আড়ালে থাকতে বলা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে বলা হচ্ছে, বিধাননগরে এ দিন থেকে ধরপাকড় শুরু হলেও রাজারহাট ও বাগুইআটিতে তা শুরু হয়ে গিয়েছে মাসখানেক আগে থেকেই। ওই এলাকায় যত না তোলাবাজি ঘিরে অভিযোগ, তার চেয়েও বেশি অভিযোগ সিন্ডিকেট ঘিরে। পুলিশ জানিয়েছে, কোনও ধরনের নির্মাণ হলেই ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের নামে তোলাবাজি চালানো হচ্ছিল রাজারহাট-বাগুইআটিতে। গত ১ মাসেরও কম সময়ে এমন প্রায় ৩৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রশাসনের এই তৎপরতায় আশার আলো দেখছে বণিকমহল। এর আগে নিউটাউনে অফিস বা আবাসন করার ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের জুলুমের সামনে পড়ার অভিযোগ করেছেন একাধিক ব্যবসায়ী। বিদেশ থেকে বিনিয়োগ করতে এসে ফিরে যেতে হয়েছে, এমন উদাহরণও বিরল নয়। এ বার তাঁদের আশা, রাজ্য সরকার সিন্ডিকেটে রাশ টানলে রাজ্যে রিয়েল এস্টেট ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সুযোগ বাড়বে। বিদেশ থেকে বিনিয়োগ করতে এসে ফিরে যেতে হয়েছে এমন এক প্রবাসী ব্যবসায়ীর মন্তব্য, ‘‘সত্যি যদি সিন্ডিকেটের দাপট কমে, তা হলে আমিও ফিরে আসতে পারি।’’