চোর ধরতে গিয়ে এ বার প্রশ্নের মুখে খোদ পুলিশের ভূমিকা!
দমদমের জেসপ কারখানায় চুরির তদন্তভার পেয়েছে সিআইডি। সেই সূত্রে আগের সব চুরির অভিযোগের নথির খোঁজ করতে গিয়েই তাজ্জব সিআইডির অফিসারেরা। পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, জেসপে লাগাতার চুরি হলেও দমদম থানা কোনও অভিযোগই দায়ের করেনি! বাধ্য হয়ে নিজেরাই অভিযোগ দায়ের করে তদন্ত নেমেছেন গোয়েন্দারা।
সিআইডির এক কর্তা বলছেন, ‘‘এত দিন ধরে চুরি হল। হইচই হল। অথচ দমদম থানা কোনও অভিযোগ দায়ের করল না!’’ পুলিশের খবর, চুরির পাশাপাশি এই অভিযোগ দায়ের না হওয়ার বিষয়টিও খতিয়ে দেখবে সিআইডি। প্রয়োজনে নিজেদের অফিসারের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে দাবি করছেন পুলিশকর্তাদের একাংশ।
এলাকাবাসীদের কাছ থেকে তদন্তকারীরা জেনেছেন, মাঝে মাঝেই দিনের বেলায় বন্ধ কারখানার ভিতরে ঢুকে যেত লরি বা ট্রাক। তাতে মাল বোঝাই করার পরে চলে যেত লরি। তদন্তকারীদের দাবি, ওই মাল কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা কর্মীরা জানতে চাইলে বেশির ভাগ লরিচালক রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য কারখানায় মাল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে দাবি করতেন। নিয়ম অনুযায়ী, জেসপ থেকে মাল অন্য কোথাও নিয়ে গেলে তা নথিভুক্ত থাকার কথা কারখানার রেজিস্টারে। কিন্তু তা নেই বলেই জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা।
সিআইডি সূত্রের খবর, চুরির ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে মানিকতলা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় গৌতম মণ্ডল নামে এক চোরাই মালের ক্রেতাকেও। তদন্তকারীদের দাবি, ধৃতের লোহার ব্যবসা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই সে বিভিন্ন দুষ্কৃতীর কাছ থেকে জেসপের চুরি হওয়া লোহালক্কড় কিনত। শুক্রবার আদালতে তোলা হলে বিচারক ধৃতের সিআইডি হেফাজতের নির্দেশ দেন। গৌতমকে জেরার পরে সে যাদের কাছ থেকে নিয়মিত চুরির মাল কিনত, তাদের একটি নামের তালিকা তৈরি করেছেন গোয়েন্দারা। জেরায় গৌতম দক্ষিণ এবং উত্তর ২৪ পরগনার একটি বড়সড় দুষ্কৃতী চক্রের নাম বলেছে বলে সূত্রের খবর।
এ দিন দমদম থানার বিরুদ্ধে তোপ দেগেছে কংগ্রেসও। এ দিন বিকেলে জেলা কংগ্রেস সভাপতি তাপস মজুমদারের নেতৃত্বে কংগ্রেস কর্মীরা মিছিল করে দমদম থানায় গিয়ে স্মারকলিপি জমা দেন। তাপসবাবু বলেন, ‘‘জেসপে কারা চুরি করে, কাদের মদতে চুরি হয়— তা সাধারণ মানুষও জানে। সব ঘটনার মূলে রয়েছে দমদম থানার নিষ্ক্রিয়তা।’’ রাজ্য পুলিশের একাংশ অবশ্য শুধু দমদম থানাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, জেসপে চুরি নিয়ে বারবার হইচই হলে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের কর্তারা কেন দমদম থানাকে অভিযোগ দায়ের করতে বলেননি? এ ক্ষেত্রে তাঁদেরও সমান দায় রয়েছে। ‘‘আগুন লাগার পরে যে সব পুলিশকর্তারা জেসপে এসে বাহিনীর নিচুতলার কর্মীদের উপরে হম্বিতম্বি করলেন, তাঁরা এত দিন কী করছিলেন?’’— প্রশ্ন রাজ্যের এক আইপিএস অফিসারের।
পুলিশের আর একটি সূত্র বলছে, আগুন লাগার পরে দমদম থানার আইসি পার্থরঞ্জন মণ্ডল যে অভিযোগ দায়ের করেন, তাতে চুরির ঘটনার দায় কার্যত মালিকের উপরে চাপিয়েছেন তিনি। আইসি বলেছেন, কারখানায় বারবার চুরি ঠেকাতে মালিকপক্ষ কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন। হাইকোর্ট চুরি ঠেকাতে পুলিশি সহায়তার নির্দেশ দিয়েছিল। তাঁর অভিযোগ, পরবর্তী কালে পুলিশ কিছু সুপারিশ করলেও মালিকপক্ষ তাতে গা করেনি। চুরির ঘটনা ঘটলেও অভিযোগও দায়ের করেনি। এমনকী, পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ কোনও রকমের সাহায্য করেনি বলে দাবি করেছেন
ওই আইসি।
এ দিন ব্যারাকপুরের ডেপুটি শ্রম কমিশনার আশিস সরকার জেসপের কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেন। ঠিক হয়েছে, আগামী ২৫ তারিখ থেকে প্রত্যেক কর্মীকে জেসপের ২৮ নম্বর গেটে এসে হাজিরা দিতে হবে। কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সংগঠনগুলি দাবি করে, জেসপের অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের দিকটিও যেন খতিয়ে দেখা হয়। নবান্ন সূত্রের খবর, ৪৬০ জন কর্মীকে তিনটি শিফ্টে ভাগ করে প্রতিদিন কারখানায় আসতে হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে রাজ্য সরকার ওই কারখানা অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে মাসে ১০ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন কর্মীরা। কিন্তু কারখানা বন্ধ থাকায় হাজিরার কড়াকড়ি ছিল না। সেই সুযোগে বহিরাগতরা কারখানায় ঢুকে চুরি এবং নানা কুকীর্তি করত বলে অভিযোগ। নবান্নের দাবি, কর্মীরা নিয়মিত হাজিরা দিলে দুষ্কৃতীরা কারখানায় ঢোকার সাহস পাবে না। বিধানসভার শিল্পবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী পুর্ণেন্দু বসু দাবি করেছেন, ঠিক মতো চালালে জেসপকে ফের লাভজনক করে তোলা যাবে। তবে তার জন্য কেন্দ্রের সাহায্য প্রয়োজন। এ নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে কথা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।