সবুজে সবুজ পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা সেরেং সগড়া গ্রামটা যেন স্তব্ধতারই অন্য নাম। কিন্তু প্রকৃতির ঠান্ডা, ভেজা, সোঁদা গন্ধের মধ্যে এখন চোরা বিপদের গন্ধও পাচ্ছে পুলিশ!
ঝিলিমিলি-ফুলকুসমা কালো, ভাঙাচোরা পিচ রাস্তার ধারেই সিআরপি-র ‘জি’ কোম্পানির ১৬৯ ব্যাটেলিয়নের শিবির। বাঁকুড়া সদর থেকে একশো কিলোমিটার উজিয়ে ওই শিবিরে দিন কয়েক আগে পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার এসে জরুরি বৈঠক করে গিয়েছেন কমান্ডিং অফিসার হাজারিলাল যাদবের সঙ্গে। কেন না পাশের রাজারানি পাহাড়ে আনাগোনা শুরু হয়েছে মাওবাদীদের। এমনকী গা-ঘেঁষা গ্রামগুলোর কয়েক জনকে নিয়ে সম্প্রতি মিটিংও করে গিয়েছে চার মাওবাদী। এবং এই অবস্থায় সিআরপি যেন যতটা সম্ভব সজাগ থাকে।
বাঁকুড়ার বারিকুল এলাকার রাওতোড়ায় মাওবাদী কার্যকলাপ ছিল মারকাটারি রকমের, তবে সেটা এখন অতীত। ২০১১-র নভেম্বরে কিষেণজি নিহত হওয়ার পর থেকে সাড়ে তিন বছর ধরে মাওবাদীদের গতিবিধির যেটুকু খবর গোয়েন্দারা পেতেন, তা সীমাবদ্ধ ছিল পুরুলিয়া আর পশ্চিম মেদিনীপুরের মধ্যে। বাঁকুড়ার কোনও দিকেই ঝাড়খণ্ডের সীমানা নেই। তাই বেগতিক দেখলে চট করে ভিন রাজ্যে ঢুকে পড়ার সুবিধে নেই বলে প্রতিকূল অবস্থায় কোণঠাসা মাওবাদীরা বাঁকুড়াকে এড়িয়ে চলছে, এমনটাই ছিল ধারণা।
কিন্তু ২৬ জুলাই বারিকুলে পোস্টার পড়ার পর পুলিশ ও সিআরপি-র উপলব্ধি, নতুন করে সংগঠিত হওয়ার এই পর্যায়ে বাঁকুড়াকে বাদ দিচ্ছে না মাওবাদীরা। আর এটাই ঘুম কেড়েছে পুলিশের।
সিআরপি-র এক অফিসার বলছিলেন, ‘‘অগস্টের মাঝামাঝি আমাদের শিবির থেকে চার কিলোমিটার দূরে তিলাবনি গ্রামের কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে রান্না করা খাবার সুতান গ্রামে ডেরা বাঁধা মাওবাদীদের একটি দলের কাছে পৌঁছেছে।’’ সেই সুতান, যা একটা সময়ে কার্যত মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছিল।
অথচ ২০১১-র শেষ থেকে মোটের উপর গোটা জঙ্গলমহলই মাওবাদীদের জন্য খাবার দেওয়া এক রকম বন্ধ করেছিল। তিলাবনি গ্রামের এক মহিলার বক্তব্য, অগস্টের মাঝামাঝি এক রাতে তিনি ১০-১২ জন মাওবাদীর একটি দলকে গ্রামের কাছে পিচরাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে দেখেছেন। ওই মহিলার কথায়, ‘‘রাত তখন ১০টা। ওদের পিঠে স্কুলের ছাত্রদের মতো ব্যাগ ছিল। কয়েক জনের পিঠে বন্দুকও।’’
তিলাবনি থেকে চার কিলোমিটার দূরে ঝিলিমিলি বাজার। শুক্রবার সেখানে সাপ্তাহিক হাটবার। এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘গত ২১ অগস্ট চার জন মাওবাদী খদ্দের সেজে এসেছিল। হাজার দশেক টাকার কাপড়-চোপড় কিনল।’’ সেটা জেনে এক গোয়েন্দা অফিসারের মত, ‘‘মনে হচ্ছে, দলটা কাছেই কোথাও আছে।’’ কিন্তু কোথায়, সেই হদিস মিলছে না কিছুতেই।
সেরেং সগড়া সিআরপি-শিবিরের কমান্ডিং অফিসার হাজারিলাল যাদব বললেন, ‘‘এলাকার মানুষ একেবারে যেন চুপ মেরে গিয়েছে। ওদের সম্পর্কে কোনও খবরই দিচ্ছে না। এটা একটা বড় সমস্যা। মনে হচ্ছে, মাওবাদী নেতারা ফের ওদের উস্কানি দিচ্ছে।’’
মানুষ কেন মুখ খুলছেন না, সম্ভবত তারই উত্তর পাওয়া গেল হিজলি গ্রামে। লালগড় আন্দোলন-পর্বে এই হিজলি গ্রামে, আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে গ্রামের পালপাড়ায় প্রথমে ঘাঁটি গাড়ে মাওবাদীরা। তার পরে রাওতোড়া অঞ্চলের একের পর এক গ্রাম তারা দখল নেয়। পরে গ্রামের অনেকেই ধরা পড়ে যান। কিঙ্কর পালেদের মতো লোক জেলে ছিলেন দীর্ঘ দিন।
কিন্তু পরিবর্তনের সওয়া চার বছর পরেও ভালুকডাঙার জঙ্গল ঘেঁষা সেই হিজলি গ্রামে ঢোকার কোনও রাস্তা তৈরি হয়নি। ইন্দিরা আবাস নিয়ে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ। দু’টাকা কেজি চাল বিলিতেও অনিয়ম। গ্রামের যুবক বিমল পালের কথায়, ‘‘এই অবস্থায় মাওবাদীরা তো ঢুকবেই। কে আটকাবে ওদের?’’ প্রবীণ বারিদ পাল বলেন, ‘‘পরিবর্তনে কোনও লাভ হয়নি। আমরা একই আছি, যা ছিলাম বামফ্রন্ট আমলে।’’
গোয়েন্দাদের কাছে খবর, বারিকুলে পোস্টার ফেলার আগে মাওবাদীদের দলটি অনেকটা সময় কাটিয়েছিল হিজলি গ্রামে।
সিপিএমের রাওতোড়া লোকাল কমিটির সম্পাদক লক্ষ্মীকান্ত টুডুর কথায়, ‘‘মাওবাদীদের সঙ্গে থাকা যে যুবকেরা ২০১১-র বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলকে ভোট দিতে প্রচার করেছিল, তাদের অনেকেই এখন কোণঠাসা। অথচ তারা দেখছে পঞ্চায়েতে পুকুর চুরি হচ্ছে। তাই, তারাই মাওবাদীদের ফিরতে সাহায্য করছে।’’
রাওতোড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান ও হিজলি গ্রাম থেকে নির্বাচিত তৃণমূল সদস্য চৈতন হেমব্রম দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করলেও মেনে নেন, ‘‘দিন পনেরো আগে এক দল মাওবাদী গ্রামে ঢুকে রাত কাটিয়েছে।’’ তাঁর যুক্তি, ‘‘পুরনো কিছু মানুষের এখনও মানসিকতা বদলায়নি। ওদের জন্যই সমস্যা হচ্ছে।’’ এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, ‘‘ঝাড়খণ্ড থেকে বেলপাহাড়ির ভুলাভেদা অঞ্চল হয়ে জঙ্গলপথে মাওবাদীরা এখন ঘন ঘন বারিকুলের রাওতোড়ায় আসছে। কারণ, ওরা বুঝে গিয়েছে, স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে কাজে লাগালে এই পুরনো ডেরায় সংগঠনটা নতুন করে চাঙ্গা করা যাবে।’’
সেই বিপদের গন্ধই এখন পুলিশের নাকে। কপালের ভাঁজ গভীর হচ্ছে কর্তাদের। ফের কি সেই রক্তঝরা দিন ফিরতে চলেছে বাঁকুড়ার ঝিলিমিলি বা সেরেং সগড়ায়?