পরনে শাড়ি, আপাত নিরীহ মুখ। তল্লাশিতেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না মাদক।
শেষমেশ দেখা যায়, মহিলার পরনে রয়েছে একটি হাফ প্যান্টও। তার অসংখ্য পকেট। আর সেই পকেটেই ঠাসা হেরোইনের ছোট ছোট প্যাকেট। শাড়ির নীচে লুকোনো ওই প্যান্টের বিভিন্ন পকেট থেকে মোট ৩০০ গ্রাম মাদক উদ্ধার করেছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের গোয়েন্দারা।
নদিয়ার পলাশির বাসিন্দা নাসরিন বেগম নামে এই মহিলা ধরা পড়েছেন গত শনিবার। কলকাতার এক ব্যস্ত সরকারি হাসপাতালে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে মিশে থাকতেন তিনি। বাকিরা আত্মীয়-বন্ধুদের দেখতে এলেও নাসরিন আসতেন মাদক বেচতে।
তবে, কলকাতার কাউকে নয়। নাসরিনের কাছ থেকে মাদক কিনতে আসতেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের পাচারকারীরা। এ ভাবে ওই মহিলা মাসে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের মাদক কলকাতায় পাচার করতেন বলে দাবি করেছেন গোয়েন্দারা। নাসরিন উত্তরবঙ্গের মাদক মাফিয়াদের ‘ক্যারিয়ার’ বলে অনুমান করছেন গোয়েন্দাকর্তারা। তাঁর কাছে নিয়মিত খদ্দেরদের মধ্যে ছিলেন ঘুটিয়ারি শরিফ থেকে আসা তিন মহিলা শামিমা লস্কর, রোজিনা বিবি, নূরজহান গাজি। নাসরিনের কাছ থেকে মাসে প্রায় ১০ লক্ষ টাকার হেরোইন কিনে তা ১৮-২০ লক্ষ টাকায় বিক্রি করতেন তাঁরা।
পুলিশ জানিয়েছে, ঘুটিয়ারি শরিফে রোজিনার বাড়িতে মাদকের পুরিয়া তৈরি হতো। শামিমা ও নূরজহান শহরের বিভিন্ন এজেন্টদের ওই পুরিয়া বিক্রি করতেন। নিজেকে স্টিলের বাসনের বিক্রেতা বলে পরিচয় দিয়ে শহরে ঘুরতেন শামিমা। আর নূরজহান নিজেকে বলতেন কলেজছাত্রী। তদন্তকারীদের কথায়, নূরজহানের কাছে বাসন্তীর একটি কলেজের পরিচয়পত্রও উদ্ধার হয়েছে। এক তদন্তকারী জানান, নূরজহান ওই এলাকায় কলেজপড়ুয়াদের মাদক বেচতেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পুলিশের দাবি, জেরায় নাসরিন জানিয়েছেন, বছর ছয়েক আগে থেকে তিনি পলাশি ও কালীগঞ্জ এলাকার মাফিয়াদের কাছ থেকে ধারে মাদক এনে কলকাতায় পাচার করতেন। এ কারণে মাসে প্রায় কুড়ি দিন তাঁকে কলকাতায় আসতে হতো। পুলিশ জানায়, মাদক বিক্রির জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হিসেবে শহরের ওই হাসপাতালকে বেছে নিয়েছিলেন ওই মহিলা। হাজার মানুষের ভিড়ে চুপিসাড়ে হাতবদল হয়ে যেত মাদক। তবে নদিয়া থেকে কলকাতায় এসে এক গ্রাম্য চেহারার এক মহিলা হাসপাতালে বসে হেরোইন-কোকেন সরবরাহ করছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবরও ছিল। তবে কিছুতেই বাগে পাওয়া যাচ্ছিল না তাঁকে।
শনিবার রাতে খবর পেয়ে ভাঙড় থানার ঘটকপুকুরে হানা দেয় পুলিশ। সেখান থেকেই মাদক-সহ ধরা পড়েন নাসরিন। সঙ্গে রোজিনা, নূরজহান ও শামিমা। নাসরিনের কাছে উদ্ধার হওয়া মাদকের দাম প্রায় সাড়ে ছ’লক্ষ টাকা বলে জানিয়েছে পুলিশ। শুধু মাদক নয়, নাসরিনের লুকোনো প্যান্টের কয়েকটি পকেট থেকে নগদ ৬৫ হাজার টাকাও উদ্ধার করেছে পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি, এই চার মহিলাই কলকাতা-সহ দক্ষিণ শহরতলিতে মাদক চক্রের অন্যতম মূল পাণ্ডা।
পুলিশ জানিয়েছে, ভোরের ট্রেনে নদিয়া থেকে কলকাতায় আসতেন নাসরিন। বিকেলের ট্রেনে পলাশি ফিরে যেতেন। বেশ কিছু দিন ধরেই পুলিশ তাঁর পিছু ধাওয়া করছিল। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া ওই ‘কেরিয়ার’কে কিছুতেই ধরা যাচ্ছিল না। সূত্রের খবর, নিয়মিত শামিমাদের মাদক সরবরাহ করতে করতে তাঁদের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ হয়ে গিয়েছিল নাসরিনের। সেই বন্ধুত্বের খাতিরেই গত শনিবার রোজিনা তাঁকে বাড়ির এক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেন। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে শামিমা ও নূরজহানের সঙ্গে ঘুটিয়ারি শরিফে যাওয়ার কথা ছিল নাসরিনের। সেই খবর পৌঁছে যায় পুলিশের কাছে।
পরিকল্পনা মতো শিয়ালদহের ওই হাসপাতাল চত্বরে দেখা হয় তিন জনের। পুলিশের দাবি, ওই হাসপাতাল থেকেই তিন জনকে গ্রেফতার করা যেত। কিন্তু পুরো দলটিকে জালে ধরার জন্যই ঘটকপুকুর পর্যন্ত ধাওয়া করে পুলিশ। বাকি তিন জনকে বাড়ি নিয়ে যেতে ঘটকপুকুরে এসেছিলেন রোজিনা। সেখানে একসঙ্গে চারজনকে পেয়ে গ্রেফতার করে পুলিশ।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বছর চারেক আগে রোজিনার স্বামী শওকত সর্দার মাদক পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তিনি এখন জেলে। স্বামীর সেই ‘রমরমা’ ব্যবসা বন্ধ হতে দেননি রোজিনা। স্বামী পরিত্যক্তা বোন শামিমা ও অনাথ বোনঝি নূরজহানকে নিয়ে মাদক ব্যবসা শুরু করেন রোজিনা। নাসরিনও স্বামী পরিত্যক্তা।
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, রোজিনার স্বামী শওকত যখন মাদক পাচারের কাজ করছিলেন, তখন নিয়মিত মাদক সরবরাহ করতে আসতেন নাসরিন। তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে রোজিনার আলাপ। তদন্তকারীদের কথায়, স্বামী জেলে যাওয়ার পরে নাসরিনের সঙ্গে যোগাযাগ করেন রোজিনা। নদিয়া থেকে মাদক এনে রোজিনাদের মাদক সরবরাহ করা শুরু করেন নাসরিন।
জানা গিয়েছে, প্রথমে প্রায় মাস ছয়েক ধারেই রোজিনাদের মাদক সরবরাহ করেন নাসরিন। তার পরে শুরু হয় নগদে কেনা-বেচা। পুলিশ জানিয়েছে, নাসরিনের কাছ থেকে কেনা মাদকের ছোট ছোট পুরিয়া তৈরি করে কলকাতার পার্ক সার্কাস, খিদিরপুরের বাবুবাজার এলাকায় বিক্রি করতেন রোজিনারা।