রাজ্যে ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার উপভোক্তা তালিকায় নাম ছিল প্রায় ৫৪ লক্ষ। ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গে আবাস-দুর্নীতির আভাস, কেন্দ্রীয় রোষের আঁচ— সবই ছিল। পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য, উপভোক্তার তালিকা তৈরির একেবারে সূচনা থেকে সতর্ক থাকলে দীর্ঘ প্রায় আট মাস কেন্দ্রীয় বরাদ্দ হয়তো বন্ধ থাকত না। তার পরে পরিস্থিতির চাপে তৎপর হওয়ায় তালিকা থেকে বাদ দেওয়া গিয়েছে ১৪ লক্ষ নাম। রাজ্যে ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার উপভোক্তা তালিকায় নাম ছিল প্রায় ৫৪ লক্ষ। ১৪ লক্ষ নাম বাতিলের পরে ২০২২-এর ৩১ ডিসেম্বর সেই তালিকায় নাম রয়েছে প্রায় ৪০ লক্ষ।
৩১ মার্চের মধ্যে সাড়ে ১০ লক্ষ বাড়ি তৈরির কাজ শেষ করতে না-পারলে আগামী দিনে বরাদ্দ পাওয়ার ক্ষেত্রেও কোপের মুখে পড়তে পারে বাংলা। এক কর্তা বলছেন, ‘‘সতর্ক থাকলে ৯০ দিনে প্রায় সাড়ে ১০ লক্ষ বাড়ি তৈরির এই বোঝা চাপত না।’’
প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, ২০২১-এর নভেম্বরে সম্ভাব্য আবাস-দুর্নীতির ইঙ্গিত দিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংশ্লিষ্ট সব মহলকে প্রকাশ্যে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তৎকালীন পঞ্চায়েত সচিব এম ভি রাও সেই মাসের ১৮ তারিখে একটি প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, দ্বিতীয় ‘ফেজ়’ বা পর্বে (প্রশাসনিক কর্তাদের মতে, সেটিই আবাস প্লাসের বর্তমান তালিকা) ৫৪ লক্ষ বাড়ি তালিকাভুক্ত হয়েছে। সে-দিনেই মমতার নির্দেশ ছিল, ‘‘কেউ যেন এখান থেকে টাকাপয়সা নিতে না-পারে।... যার চারতলা বাড়ি রয়েছে, সে পেয়ে গেল আর যার কিছু নেই, সে পেল না— এটা চলবে না।’’ প্রশাসনিক সূত্রের খবর, তার পরেই এফআইআর করে প্রকল্পের ‘বেহাত’ হওয়া টাকা উদ্ধার করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কাজ শুরু করেছিল নবান্ন।
আধিকারিক মহল মনে করিয়ে দিচ্ছে, সেই সময়েও বরাদ্দ বন্ধ করেনি কেন্দ্র। সেই টাকা সরবরাহ বন্ধ হয় ২০২২-এর মার্চে। তার পরে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা, চাপান-উতোরের পরে ফের কেন্দ্রীয় সুপারিশ মেনে তালিকা ত্রুটিমুক্ত করার কাজে নামে রাজ্য। ত্রুটিমুক্তি নিয়ে রাজ্যের আশ্বাসবার্তা পেয়ে গত নভেম্বরে ফের বরাদ্দ চালু করার বার্তা দেয় কেন্দ্র।
পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার বলেন, ‘‘অন্যান্য রাজ্য আরও আগে কেন্দ্রের বরাদ্দ পেয়েছে। আমরা পেয়েছি অনেক পরে। এত বড় কাজে আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। তাই যে-সব রাজ্য তা করতে পারেনি, তাদের বরাদ্দ আমাদের দেওয়া হোক। এটা আমাদের প্রাপ্য।’’
দ্বিতীয় পর্বের তালিকা সংশোধনের সময় গত ১০ থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাদ গিয়েছে প্রায় ৫.৮৮ লক্ষ নাম। তার মধ্যে সব চেয়ে বেশি নাম (প্রায় ১.৩৭ লক্ষ) বাদ গিয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলায়। এই দফায় কোচবিহারে একটিও নাম বাদ যায়নি। ৫০ থেকে ৬০ হাজার নাম বাদ গিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর, বীরভূম ও উত্তর ২৪ পরগনায়। ঝাড়গ্রাম, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব বর্ধমান, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ায় নাম বাদ পড়েছে ১০ থেকে ২০ হাজার। ২০-৩৫ হাজার নাম কাটা গিয়েছে হুগলি, হাওড়া, মালদহ, জলপাইগুড়ি এবং দুই দিনাজপুরে।
গত বছর মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বরাদ্দ বন্ধ থাকায় বাড়ি তৈরির অনুমোদন পেতে দেরি হয় রাজ্যের। নভেম্বরের পরে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত, কার্যত কয়েক দিনের মধ্যে অন্তত ১১.৩৬ লক্ষ উপভোক্তার বাড়ির ব্যাপারে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার নির্দেশ দেয় কেন্দ্র। তালিকা সম্পূর্ণ না-হলে অবশিষ্ট বরাদ্দ অন্য রাজ্যে পাঠানো হতে পারে বলে হুঁশিয়ারিও দেয় তারা। তাতে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৯% উপভোক্তার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে পেরেছে রাজ্য।
পঞ্চয়েতমন্ত্রী বলেন, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে জমির সমস্যা রয়েছে। অনেকে আবার অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার জেরেও সমস্যা হচ্ছে। তবে এই সব ক্ষেত্রে তিন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায়। এটা কেন্দ্রীয় বিধিসম্মত।’’