পরীক্ষার মরসুমে পুরভোটের প্রচারে মাইক ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন যে নির্দেশিকা জারি করেছিল, সোমবার তাতে স্থগিতাদেশ দিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। তাদের মতে, এই নির্দেশিকা দিয়ে কমিশন এক্তিয়ার-বহির্ভূত কাজ করেছে।
এবং এ ব্যাপারে এ দিন পরিবেশ আদালত যে নির্দেশ দিয়েছে, কমিশনের নির্দেশিকার সঙ্গে তাতে কার্যত তেমন ফারাক খুঁজে পাচ্ছেন না পরিবেশকর্মীদের একাংশ, যা কিছুটা হতাশারও সৃষ্টি করেছে। আগামী ৫ মে পর্যন্ত স্থগিতাদেশটি বলবৎ করলেও পরিবেশ আদালত কিন্তু পুরভোটের প্রচারে মাইক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। বরং তারা জানিয়েছে, শব্দ-বিধি মেনে মাইক, লাউডস্পিকার ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে। আর বিধি ঠিকঠাক মানা হচ্ছে কি না, রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসন তা দেখবে।
পশ্চিমবঙ্গে সিবিএসই পরীক্ষার এখনও বাকি চার দিন— ১৬, ১৭, ১৮ ও ২০ এপ্রিল। গত ১ এপ্রিল কমিশন নির্দেশিকা দিয়ে জানিয়েছিল, সিবিএসই চলাকালীন রাজনৈতিক দলগুলি পুরভোটের প্রচারে মাইক ব্যবহার করতে পারবে। উল্লেখ না-থাকলেও তাতে বোঝানো ছিল যে, মাইক বাজাতে হবে শব্দ-বিধি মেনেই। সেই বিধিতে কী রয়েছে?
২০০০ সালের শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধি অনুযায়ী, মাইক বাজার সময়সীমা সকাল ছ’টা থেকে রাত দশটা। তাতে বলা আছে, বসত এলাকায় মাইকের শব্দ-সীমা হবে ৫৫ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক বা বাজার এলাকায় ৬৫ ডেসিবেল ও শিল্পাঞ্চলে ৭৫ ডেসিবেল।
ঘটনা হল, পুরভোটে প্রচারের সিংহভাগ চলে বসত এলাকায়। সেখানে ৫৫ ডেসিবেলে মাইক বাজানো কি আদৌ সম্ভব?
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক বিজ্ঞানী বলেন, ‘‘অনেক সময়ে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা করে হ্যান্ডমাইকে। তার শব্দসীমা ৫৫ ডেসিবেলের মধ্যে। কিন্তু সাধারণত যে ভাবে মাইকের চোঙা লাগিয়ে ভোটের প্রচার হয়, তা ৭৫ ডেসিবেলেরও চড়া।’’ এক পরিবেশকর্মীর পর্যবেক্ষণ, ‘‘শব্দবিধি মানলে তো খোলা জায়গায় মাইক বাজানোই কার্যত অসম্ভব!’’
বস্তুত এ দিন সন্ধ্যায় বেহালা চৌরাস্তার মোড়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী সভায় তারস্বরে মাইক বেজেছে। বেহালা চৌরাস্তার কাছে একটি শিল্পতালুক রয়েছে। সেই সুবাদে ওই সভায় মাইকের শব্দসীমা ৭৫ ডেসিবেল। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের অনেকের দাবি, শব্দের দাপট এ দিন ১০০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে গিয়েছে। উপরন্তু গোটা তল্লাট জুড়ে লাগানো মাইকের বিস্তর চোঙা মারফত বসত এলাকাতেও দাপিয়ে বেড়িয়েছে শব্দ-দানব।
তবে এ সবে নজর রাখার জন্য পুলিশ-প্রশাসনের কোনও আধিকারিক সেখানে ছিলেন না। যার প্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, তথা শব্দ-যুদ্ধের অন্যতম সেনানী ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর সভায় শব্দ-বিধি মানা হচ্ছে কি না, তা দেখতে যাওয়ার সাহস রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসনের কোনও কর্তার আছে নাকি?’’ তাঁর মতে, ‘‘শব্দবিধি কার্যকর করতে জাতীয় পরিবেশ আদালতের উচিত ছিল অন্তত এক জন স্পেশ্যাল অফিসার নিয়োগ করা।’’ তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এ দিন দাবি করেছেন, ‘‘পরিবেশ-বিধি মেনেই আমরা মাইক ব্যবহার করি।’’
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মাইক-নির্দেশিকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জাতীয় পরিবেশ আদালতের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চে মামলা রুজু করেছিলেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তাঁর দাবি, এমন নির্দেশ দেওয়ার এক্তিয়ার কমিশনের নেই। আছে পুলিশ-প্রশাসনের। ওই মামলার প্রেক্ষিতেই পরিবেশ আদালতের বিচারপতি প্রতাপ রায় ও বিশেষজ্ঞ-সদস্য পি সি মিশ্রের বেঞ্চের এ দিনের স্থগিতাদেশ। যাকে নিয়মরক্ষার বেশি কিছু বলে ভাবতে পারছেন না পরিবেশকর্মীদের একাংশ। কোর্ট পরীক্ষার মধ্যে মাইকে নিষেধাজ্ঞা জারি না করায় তাঁরা হতাশ। সুভাষবাবু বলেন, ‘‘পরিবেশ আদালতের কথায় স্পষ্ট, কমিশন অনধিকার চর্চা করেছিল। তাই স্থগিতাদেশ।’’ এতে কি পরীক্ষার্থীরা শব্দের তাণ্ডব থেকে মুক্তি পাবেন? সুভাষবাবুর জবাব, ‘‘পরীক্ষার্থীরা স্বস্তি পেলেন কি না, সে সম্পর্কে আমি সন্দিহান। তবে শব্দের যে তাণ্ডব চলছিল, তা নিয়ন্ত্রণের সূচনা হয়তো হল।’’ রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় বলেন, ‘পরিবেশ আদালতের নির্দেশ আমরা সব জেলার ডিএম-এসপিকে ও কমিশনারেটের সিপি-দের পাঠাব। কোথাও মামলা হলে প্রশাসনের কর্তারাই ব্যবস্থা নেবেন।’’
সিপিএমের মতে, কোর্টের রায় মানতে গেলে প্রচারে মাইক ব্যবহার অসম্ভব। সিপিএম নেতা রবীন দেব বলেন, ‘‘এতে দলগুলো অসুবিধায় পড়বে। এর দায়িত্ব রাজ্য ও কমিশনের। আমরা ভোট পিছোতে বলেছিলাম।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘এ আর নতুন কী? এটা মেনেই এত কাল প্রচার করেছি।’’ রাহুলবাবুর ধারণা, আদালত হয়তো পুরনো নিয়মটাই ফের মনে করাল! কংগ্রেসের আব্দুল মান্নানের মন্তব্য, ‘‘আমরাও বলেছিলাম, পরীক্ষা মিটলে ভোট হোক। কমিশন আর রাজ্য ইচ্ছে করে এই পরিস্থিতি তৈরি করল!’’ সোমবার রাতে ধর্মতলার কাছে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর এক সভায় মাইকেই প্রচার হয়েছে।
১৯৯৭-এ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও সম মর্যাদার দিল্লি বোর্ড ও কাউন্সিলের সমস্ত পরীক্ষার তিন দিন আগে থেকে পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত মাইক ব্যবহারের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তার ভিত্তিতে এবং ২০০০ সালের শব্দ (নিয়ন্ত্রণ) বিধি মাথায় রেখে পরিবেশ দফতর ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বছর বছর এই সব পরীক্ষার আগে নির্দেশিকা জারি করে আসছে। কিন্তু এ বছর ১ এপ্রিল জারি করা কমিশনের নির্দেশিকাটি সরকারি সেই নির্দেশিকার পরিপন্থী ছিল বলে মত পরিবেশকর্মীদের একাংশের। ডিভিশন বে়ঞ্চ যাঁকে ‘আদালত-বান্ধব’ হিসেবে নিয়োগ করেছে, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সেই অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন-অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ও কোর্টে বলেন, সিবিএসই-র ক্ষেত্রে রাজ্যের নির্দেশকে কমিশন অগ্রাহ্য করেছে। আর নির্দেশ দেওয়ার সময়ে কোর্ট মনে করিয়েছে, পরীক্ষার প্রস্তুতিতে পরীক্ষার্থীদের যাতে অসুবিধা না-হয়, মাইক ব্যবহার কালে তা মাথায় রাখতে হবে।
কিন্তু সেটা কে কী ভাবে রাখবে, বা আদৌ রাখা হবে কি না, তা-ই এ মুহূর্তে বড় প্রশ্ন।