বিনা কারণে রাস্তায় বার হওয়া মাস্কহীন যুবককে ধাওয়া সিভিক পুলিশের। শনিবার বালুরঘাটে। ছবি: অমিত মোহান্ত
বৃহস্পতিবারের ছবিটা সন্তোষজনক ছিল। শনিবারের চিত্রও তেমনই।
দিনেদুপুরে শহর কলকাতার বিভিন্ন ব্যস্ততম মোড়ের জনহীন ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছে কলকাতা পুলিশ। সঙ্গে গর্বিত ঘোষণা, কড়া লকডাউন চলছে। কৃষ্ণনগর থেকে কোচবিহার, মেদিনীপুর থেকে মালদহের ছবিটাও আলাদা নয়। তবু সব মিলিয়ে এ সব দেখেও অনেকেই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। মালদহের এক পুলিশকর্তা হাসছেন, ‘‘সবই হালকা লাঠ্যৌষধি বা কান ধরে ওঠবসের মহিমা।’’ হাওড়া সেতুতে কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের সোজা কথা, ‘‘আগের দিন অনেক গাড়ি আটকে মোটা জরিমানা হয়েছে। একটা কড়া বার্তা গিয়েছে। আজ গাড়ি হাতে-গোনা।’’
তাই নিশ্ছিদ্র লকডাউন দেখেও বাঙালির স্বভাব পাল্টানোর বিশ্বাসে জোর নেই। বরং আজ, রবিবার মাছের বাজারে অনিবার্য জনবিস্ফোরণ নিয়ে কার্যত সংশয় নেই। কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘রাজ্যে লকডাউনের ঠিক আগে বা পরের ছবি অত্যন্ত অস্বস্তির। বাজারের ঠাসাঠাসিতে অঘটনের ভয়েই কাঁটা হয়ে আছি!’’
লকডাউনের দিনের শৃঙ্খলা কি আদৌ নিজেকে বা অন্যকে বাঁচানোর সচেতনতা? নাকি আইন বা পুলিশকে ভয়? পুলিশপ্রশাসনের বড় অংশ ‘শক্তের ভক্ত’ জনগণের সাময়িক পিছু হটা দেখছেন। প্রবীণ সাহিত্যিক বাণী বসুর মতে, ‘‘বাধ্য নাগরিক মুষ্টিমেয়। বেশিরভাগই স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতার পূজারী।’’
রাস্তায় থুতু না-ফেলা, মাস্ক পরা, ঠেলাঠেলি এড়ানো বা দফায় দফায় হাত ধোয়ার ব্যবহারিক সংস্কৃতি অতিমারিতে সবার স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে উঠবে, এমনটা অনেকেই আশা করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় ছাড়া স্বভাব যে সহজে যাওয়ার নয়, তা-ও বলে থাকেন মনস্তত্ত্ববিদেরা।
মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম অবশ্য বলেন, ‘‘লোকে বুঝছে না বা সচেতন হচ্ছে না বলার মধ্যেও এক ধরনের উন্নাসিকতা আছে। বোঝানো বা বোঝাতে না-পারার দায়টাও প্রশাসনের উপরে বর্তায়।’’ তিনি বা কার্ডিয়োথোরাসিক সার্জন কুণাল সরকার আমনাগরিককেই এক তরফা বিশৃঙ্খল বলে দেগে দিতে চান না। কুণালবাবুর মতে, ‘‘ক্যালিফর্নিয়া বা টেক্সাসের মতো শপিংমলে ঢোকা বা মাস্ক না পরার দাবিতে আন্দোলন তো এখানে হচ্ছে না।’’ চেনাজানার মধ্যে করোনার বাড়বাড়ন্ত বা হাসপাতালে বেড পাওয়ার দুশ্চিন্তাতেও বরং অনেকে ঘরবন্দি থাকছেন বলে কুণালবাবুর দাবি। কিন্তু প্রশ্ন হল, মাস্ক পরা-সহ অন্য বিধি মেনে চলার বিষয়ে সরকারি এবং বেসরকারি তরফে যথেষ্ট প্রচার করা হচ্ছে। আর তা করতে হবেই বা কেন? সমাজতত্ত্বের শিক্ষক উপল চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘রোজ রোজ সরকার বা পুলিশ দিয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে এটাও কখনওই কাম্য বা সম্ভব নয়। কিছু মানুষের পক্ষে অবশ্যই পারষ্পরিক দূরত্ব মেনে চলায় সমস্যা আছে। তবু অনেকেই চাইলে খানিকটা চেষ্টা করতে পারেন।’’ তিনি বলছেন, ‘‘পাশের লোকটিকে বা নিজেকে বাঁচাতে কী করা উচিত তা নিয়ে এখন অস্পষ্টতা নেই। এর পরেও না-বুঝলে সেটা চরম দায়িত্বজ্ঞানতা।’’
তা হলে পাঁচ দিন ভিড় এবং দু’দিনের লকডাউন শৃঙ্খলায় কি ভাইরাসকে কব্জা করা যাবে? রাজ্যের মন্ত্রী তথা নাট্যব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু বলছেন, ‘‘আমাদের দেশ চিনের নিয়মে চলে না। তাই মানুষের সচেতনতা ছাড়া গতি নেই। মানুষের রুটিরুজিতে টান পড়ার কথা ভেবেই টানা লকডাউনের পথে হাঁটা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে এটাও বলা হচ্ছে, নিরুপায় না-হলে বেরোবেন না! এটা পাড়ার মোড়ে আড্ডার সময় নয়!’’