মানুষ কোতল করতেও শিখেছি, জানাল রাজিয়া

দেখলে মনে হবে তারা যেন আর দশটা গাঁয়ের সাধারণ মেয়ে-বৌয়েরই এক জন। কিন্তু, এতটাই শক্ত মন তাদের যে তাবড় পুলিশ ও গোয়েন্দাদের জেরার মুখে একবারের জন্যও কেঁপে উঠছে না ঠোঁট, চোখের পাতা। তদন্তকারীদের চোখে চোখ রেখে, চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিচ্ছে তারা। অবশ্য সেই সব প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যাচ্ছে, যেটা তারা দিতে চাইছে। না-পসন্দ প্রশ্ন শুনে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকছে উল্টো দিকে বসা অফিসারের দিকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:২৯
Share:

খাগড়াগড়ে গত বৃহস্পতিবারের বিস্ফোরণের পরে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রাজিয়া বিবি (সামনে) ও আলিমা বিবিকে। ছবি: উদিত সিংহ

দেখলে মনে হবে তারা যেন আর দশটা গাঁয়ের সাধারণ মেয়ে-বৌয়েরই এক জন।

Advertisement

কিন্তু, এতটাই শক্ত মন তাদের যে তাবড় পুলিশ ও গোয়েন্দাদের জেরার মুখে একবারের জন্যও কেঁপে উঠছে না ঠোঁট, চোখের পাতা।

তদন্তকারীদের চোখে চোখ রেখে, চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিচ্ছে তারা। অবশ্য সেই সব প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যাচ্ছে, যেটা তারা দিতে চাইছে। না-পসন্দ প্রশ্ন শুনে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকছে উল্টো দিকে বসা অফিসারের দিকে। অস্বস্তিতে পড়ে যাচ্ছেন পোড় খাওয়া অফিসারও। কোনও প্রশ্নের জবাবে সরাসরি বলে দিচ্ছে, “বলব না।” কখনও ‘ভুল’ উত্তর দিয়ে বিপথে চালিত করার চেষ্টা করছে।

Advertisement

দু’জনেই কোলে শিশু-কন্যা নিয়ে পুলিশ হেফাজতে। আলিমার বয়স মেরেকেটে ২০, রাজিয়ার ২২। বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত বাংলাদেশের নাগরিক শাকিল আহমেদের স্ত্রী রাজিয়া। ওই একই ঘটনায় আহত আবদুল হাকিমের স্ত্রী আলিমা।

এক সময় মাওবাদীদের স্কোয়াডে জাগরী বাস্কে, সুচিত্রা মাহাতোর মতো কড়া ধাঁচের মহিলারা পুলিশের ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন। এ কে ৪৭ নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন তাঁরা। তাঁদের সামনে বসিয়ে জেরা করেছেন, এমন অভিজ্ঞ পুলিশ ও গোয়েন্দা অফিসারেরা এ বার রাজিয়া-আলিমার মুখোমুখি বসে ঘেমে যাচ্ছেন। সেই অফিসারদের এক জনের কথায়, “জাগরী-সুচিত্রার তা-ও মনের ভিতরে ভয় ছিল। এদের মধ্যে ভয়ডরের চিহ্নমাত্র নেই। ভয়ানক হার্ডকোর।” রাজিয়া জানিয়েছে, ‘কী করে মানুষকে কোতল করতে হয়’ তা-ও তার শেখা আছে। শেখানো হয়েছে, ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যদি প্রাণ যায়, তা হলে জন্নত (স্বর্গ) যাওয়া যায়’। তাই, কান-ফাটানো বিস্ফোরণের শব্দ শুনে পাশের ঘরে এসে সে যখন দেখে, মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় স্বামী শাকিল পড়ে রয়েছে, তার বুক কেঁপে ওঠেনি। সে ও আলিমা বাচ্চা দু’টোকে বিস্ফোরণে ধ্বস্ত ঘরের এক কোণে বসিয়ে রেখে, সুনিপুণ হাতে চোয়াল শক্ত করে ঘর থেকে একের পর এক প্রমাণ মুছে ফেলার কাজ করেছে।

অফিসারের প্রশ্ন ছিল, কেন? উত্তরে রাজিয়া বলে, “আমাদের ব্যক্তিগত জিনিস বাইরের লোকেদের দেখাতে দিতে চাইনি, তাই।” পাল্টা প্রশ্ন ছিল, আপনার স্বামীকে ওই অবস্থায় দেখে কষ্ট হয়নি? মনে হয়নি ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচেও যেতে পারেন? উত্তর পাওয়া গিয়েছে, “আমার স্বামী জেহাদ করতে গিয়ে মারা গিয়েছে। ওর জন্য আমি গর্বিত। আর দেখেই তো বুঝেছিলাম, ওর দেহে আর প্রাণ নেই। তাই, আমার কর্তব্য করে গিয়েছি।” ‘কর্তব্য’ বলতে কাপড় দিয়ে রক্ত মোছা, লিফলেট, বই, মোবাইল ফোন আগুনে ছুঁড়ে ফেলা। এক অফিসারের কথায়, “ভাবুন, কতটা মনের জোর থাকলে ওই অবস্থায় একটা বিস্ফোরণ স্থলে দু’টো মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ফোরণের আগুনেই কেউ তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করতে পারে! ভয়ঙ্কর রকম অনুপ্রেরণা না থাকলে এটা হয় না।”

এখনও পর্যন্ত পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে যতটুকু তথ্য এসেছে তা এই দু’জনই দিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গিয়েছে, বিয়ের আগে রাজিয়া করিমপুর থেকে এবং আলিমা বহরমপুর থেকে বর্ধমানের একটি মাদ্রাসায় পড়তে যেত। সেখানেই দু’জনের আলাপ। সেখানেই শাকিল ও হাকিমের সঙ্গে তাদের দেখা। শাকিল তখন বাংলাদেশ থেকে এসে ওই মাদ্রাসায় জেহাদিদের অনুপ্রেরিত করত। বাংলাদেশের মৌলবিদের রেকর্ড করা বক্তৃতা শোনাত। রাজিয়াকে বিয়ের সিদ্ধান্ত সেখানেই। সেখানেই শিবির করে শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় রাজিয়া-আলিমাদের। পুলিশকে তারা জানিয়েছে, গ্রেনেড, বিস্ফোরক বানাতে পারে দু’জনেই। ছোটখাটো বন্দুকও চালাতে পারে। দুর্ঘটনার পর স্থানীয় মানুষ বাড়িতে ঢুকতে গেলে তারাই বাধা দিয়ে বলেছিল, “গুলি করে দেব।”

দুর্ঘটনার আগের দিন পর্যন্ত ইসলাম নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনাও করেছে তারা। জেরার মুখে তারা জানিয়েছে, শাকিলই পড়াশোনা করার কথা বলত। শাকিলের সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরের কিছু জেহাদির যোগাযোগের সূত্র পেয়েছেন গোয়েন্দারা। জম্মু-কাশ্মীর যাওয়ার কথা ছিল তাদের? প্রশ্ন শুনে, রাজিয়া জানায়, কিছু দিন আগে শাকিল নাকি তাদের দু’জনকে বলেছিল, ‘তৈরি থাকো। ইসলামের জন্য লড়তে হতে পারে!’ তবে সেটা কাশ্মীরের প্রেক্ষিতে কি না, তা নিয়ে অবশ্য নিশ্চিত নন তদন্তকারীরা।

গোয়েন্দাদের মতে, মাদ্রাসায় প্রশিক্ষণের পর থেকেই জেহাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে রাজি হয়ে যায় রাজিয়া-আলিমা। কন্যা-সন্তান নিয়ে সংসার করছিল ঠিকই, কিন্তু, মনের ভিতরে ছিল অন্য এক স্বপ্ন। তাদের অনুতাপহীন মন, ভাবলেশহীন চোখ-মুখই বলে দেয়, প্রিয়জনের মৃত্যুও স্পর্শ করে না তাদের। প্রায় চার দিন হয়ে গেল বাড়ির কেউ এসে দেখা পর্যন্ত করেননি। তার জন্য সামান্যতম হেলদোল নেই তাদের। দুই মহিলার কথাবার্তা শুনে ইরাকের ইসলামিক স্টেট-এর সেই সব কট্টর তরুণী জেহাদিদের কথাই মনে পড়ছে গোয়েন্দাদের, যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জেহাদের নামে পরিবার ছেড়ে, স্কুল-কলেজ ছেড়ে ইরাকে আই এস-এ যোগ দিচ্ছে। এই সব মেয়েদের কথা বার বার তুলে ধরছে বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলি। গোয়েন্দাদের মতে, এখানেও রাজিয়া-আলিমাদের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। আশঙ্কা, এক শ্রেণির মাদ্রাসায় প্রশিক্ষণ নিয়ে শক্তিশালী স্কোয়াড হিসেবে উঠে আসছে গ্রাম-বাংলার এই যুবতীরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement