বনভোজনের ভিড়। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে তোলা নিজস্ব চিত্র।
সকালের কুয়াশা কেটে নরম রোদে ঝলমল করছে মুকুটমণিপুর জলাধার। ব্যাডমিন্টের র্যাকেট হাতে বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় মশগুল ছোট্ট সুমন। একটু দূরে রান্নার তদারক করছেন তার মা পিয়ালী সূত্রধর। রবিবার, বড়দিন। পড়ার আরও তিনটি পরিবারের সঙ্গে পিকনিক করতে মুকুটমণিপুরে এসেছে সূত্রধর পরিবার। কর্তা বাবুল সূত্রধর বলেন, ‘‘টাকাকড়ি নিয়ে সমস্যা তো আছেই। কিন্তু বচ্ছরকার এই একটা দিনও কি সেই ভাবনাতেই কাটবে! অনেক আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম, এ বারও পিকনিক হবেই।’’
দুই জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্থলে রবিবার জমে উঠেছিল বড়দিনের পিকনিক। আশঙ্কা ছিল, নোটের চোটে এই দিনটাও না কুপোকাত হয়ে যায়। কিন্তু সমস্ত কিছু সামলে মানুষের ঢল এ দিন নেমে এসেছে বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুর, বিষ্ণুপুর বা পুরুলিয়ার অযোধ্যা, জয়চণ্ডীতে। ঘুরে দাঁড়ানোর গোপন কথাটা কী? বাবলু জানান, সবাই মিলে আনন্দে একটা দিন কাটাতে খরচ বেশি নয়। ভাত, বাঁধাকপির ঘণ্ট, মুরগির মাংস আর শেষ পাতে চাটনি। বাড়িতে একটু ভালমন্দ খাওয়াদাওয়া হলেও এটুকুই হয়। শুধু সবাই মিলে গাড়ি ভাড়া করে চলে আসা প্রকৃতির মাঝে। মাথাপিছু একশো থেকে বড়জোর দু’শো টাকা খরচ।
গৃহস্থ পরিবার, স্কুল কলেজের পড়ুয়া, চাকরিজীবী যুবক-যুবতী সবাই সামিল বড়দিনের আনন্দে। মুখে হাসি ফুটেছে মুকুটমণিপুরের নৌকাচালকদেরও। এ বছর মুকুটমণিপুর জলে টইটম্বুর। নৌকাচালক পরেশ বাগদি, তপন বাগদিরা বলেন, ‘‘গত বছর জল না থাকায় ব্যবসা মার খেয়েছিল। এ বছর ভেবেছিলাম নোট বাতিল আবার সমস্তটা মাটি করে দেবে। কিন্তু সময়কালে দেখছি, আগের বছরের থেকে অনেক ভাল ব্যবসা হল।’’
বিষ্ণুপুরে আবার বড়দিনের উপরি পাওনা মেলা। সেই উপলক্ষে অনেক পর্যটক দূর দূরান্ত থেকে শহরে এসেছেন। বিষ্ণুপুর হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অসিত চন্দ্র বলেন, “শহরে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৩৬টি লজ ও হোটেলে প্রায় হাজার দুয়েক মানুষের থাকার বন্দোবস্ত রয়েছে। দু’-একটি বাদে প্রতিটাই ভরে গিয়েছে।’’ মেলা কমিটির সভাপতি তথা বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীর দাবি, ২৯তম বর্ষের মেলায় এ দিনের ভিড় অন্য বারের তুলনায় অনেকটাই বেশি।
বাঁকুড়ার মুটকুটমণিপুর জলাধারে রবিবারের নিজস্ব চিত্র।
রবিবার সকাল থেকেই ঐতিহাসিক মন্দির, মিউজিয়াম, লালবাঁধ, লালগড় প্রকৃতি উদ্যান থিকথিক করেছে ভিড়ে। ঘণ্টায় নিদেন পক্ষে দু’শো টাকার কড়ারে ভাড়া হয়েছে তপন মাহাতো, সমীর নন্দীদের টোটো। তাঁরা বলেন, ‘‘স্নান-খাওয়ার ফুরসত পাইনি। গত বারের চেয়ে অনেক ভাল রোজগার হয়েছে।’’ তবে এই সুবাদে অল্পবিস্তর যানযটে নাকাল হতে হয়েছে শহরের বাসিন্দাদের।
শুশুনিয়াতেও বনভোজন করতে আসা মানুষের ভিড় ছিল। বিষ্ণুপুর মেলা দেখতে এসে অনেকেই শুশুনিয়াতেও ঢুঁ মেরে গিয়েছেন। জমজমাট ছিল গঙ্গাজলঘাটির অমরকাননের কোরো পাহাড়, সারেঙ্গার বড়দি পাহাড়।
ডিসেম্বরের প্রথম তিনটে সপ্তাহ কার্যত ফাঁকাই ছিল পুরুলিয়ার অযোধ্যা, জয়চণ্ডী, পঞ্চকোট। তবে বড়দিনে হাসি ফুটেছে স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং গাইডদের মুখে। পুরুলিয়ায় এক কালে পর্যটনস্থল বা পিকনিক স্পট বলতে প্রথমেই উঠে আসত অযোধ্যা পাহাড়ের নাম। মাওবাদী সমস্যায় সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা অনেক কমে গিয়েছিল। কদর বাড়ছিল জেলার উত্তর প্রান্তে রঘুনাথপুর মহকুমার গড়পঞ্চকোট, জয়চণ্ডী আর বড়ন্তির। মাওবাদী সমস্যা কমার পরে গত চার-পাঁচ বছরে পর্যটকদের ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠছে অযোধ্যার শীতকাল। এই বড়দিনেও পুরুলিয়ার সমস্ত পাহাড়েই সেই চেনা ছবি দেখা গিয়েছে। রঘুনাথপুর শহরের শান্তনুপ্রসাদ মিশ্র, জয়দীপ দেওঘরিয়া বা ঝাড়খণ্ডের সুদামডির দুলাল চট্টোপাধ্যায়রা বলেন, ‘‘বড়দিনের পিকনিকের মজাই আলাদা। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম এ বারে জয়চণ্ডীতে আসব।’’
অযোধ্যা পাহাড়ের সুন্দরী অযোধ্যা পর্যটন কমিটির কর্মকর্তা নিবারণচন্দ্র মাহাতো, স্থানীয় গাইড বেনু সেনরা জানান, গত বছরের চেয়ে এ বারের ভিড় বেশি বই কম নয়। পাহাড়ের নিচে লহরিয়া শিবমন্দির লাগোয়া এবং আশপাশের মাঠে বাস দাঁড় করিয়ে অনেকই ছোট গাড়ি ভাড়া করে পাহাড়ের উপরে উঠেছেন। ঘুরেছেন পিপিএসপি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আপার ও লোয়ার ড্যাম, সীতাকুণ্ড, উসুলডুংরি।
ভাল ভিড় হয়েছিল গড়পঞ্চকোট পাহাড়ে। বড়দিনের আগে থেকেই পাহাড়ের সরকারি, বেসরকারি রিসর্টগুলি ভর্তি হয়ে গিয়েছে। সেই পর্যটকেরাও এ দিন ছড়িয়ে পড়েছেন পাহাড় জুড়ে। মানবাজারের দোলাডাঙা, হুড়ার ফুটিয়ারি— চড়ুইভাতির ভিড় ছিল সর্বত্র। মানবাজার পঞ্চায়েত সমিতির অধিকাংশ কর্মকর্তা এ দিন সপরিবারে দোলাডাঙায় উপস্থিত ছিলেন। ক্যুইজ, গল্প, আড্ডায় জমজমাট বড়দিন কাটান তাঁরা। ছিলেন স্থানীয় বিধায়ক তথা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী সন্ধ্যারানি টুডু। মানবাজার ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কবিতা মাহাতো বলেন, ‘‘সাধারন দিনে ব্লকের কর্মীদের সঙ্গে গল্প আড্ডা হয় না। এই সুযোগে সেটা হয়ে গেল।’’ মুকুটমণিপুরে পিকনিক করতে এসে বাঁকুড়ার মাচানতলার সুধীর দাস, নন্দিতা দাসের মতো অনেকেই জলাধার পেরিয়ে ডিয়ার পার্ক এবং দোলাডাঙা ঘুরে গিয়েছেন।
ক’টা দিন পরেই নতুন বছর। বড়দিনে অনেক আশা জমিয়ে সেই দিকেই আপাতত তাকিয়ে দুই জেলার ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষজন।