জনতার কাছাকাছি। আলিপুরদুয়ার নতুন জেলা ঘোষণার দু’বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার সন্ধ্যায় আলিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ডে। — নিজস্ব চিত্র
টেনেটুনে সাত মাস হবে। বিডিও অফিসে গিয়ে ঋণের আবেদন করেছিলেন প্রণয় দেবনাথ। কিছুদিন আগে প্রশাসনের কর্তারা জানিয়েছেন তাঁর ঋণ মঞ্জুর হয়ে গিয়েছে। একাধিক নথি, রিপোর্ট জমা দিয়ে সরকারি ঋণ এত দ্রুত মঞ্জুর হবে তা বিশ্বাস করতে পারেননি প্রণয় দেবনাথ। সোমবার সন্ধ্যেয় মুখ্যমন্ত্রী মততা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে ঋণের কাগজ নমিয়ে যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন তখনও যেন অবিশ্বাসের ঘোর কাটেনি তাঁর মুখ থেকে।
দু’বছর আগে জন্ম নেওয়া জেলার জন্মদিনের অনুষ্টানে আসা এমন অনেকের চোখে-মুখেই বিস্ময়ের ঘোর দেখা গিয়েছে। কেউ বা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, পেনশনের জন্য আর দূরের জলপাইগুড়ি সদরে যেতে হয় না। নিজের শহরেই কাজ হয়ে যাচ্ছে। কেউ বা বেকার যুবক ছিলেন, নতুন জেলা বলে স্বনিযুক্তি প্রকল্পের ঋণ এবং পরিধি বাড়ায় তিনিও পেয়েছেন। তা দিয়ে চায়ের দোকান গড়েছেন।
তবে সবটাই পেয়েছি-পাব এমন নয়, শোনা গিয়েছে উৎকণ্ঠা-অপেক্ষাও। দু’বছর হয়ে গেল আলিপুরদুয়ারে জেলা আদালত হয়নি। সোমবার প্যারেড গ্রাউন্ডে আসা আইনজীবীদের অনেকেই জানতে চেয়েছেন কবে জেলা আদালত হবে। সেই প্রশ্ন জেলা আদালতের সামনের ব্যবসায়ীদের মুখেও। জেলায় গড়ে ওঠেনি নতুন কোনও শিল্পও। যদিও, এ দিন মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন উন্নয়নের আরও প্রকল্প দ্রুত ঘোষণা হবে। নতুন জেলাকে ঘিরে এমন আশা-উৎকন্ঠার গল্প-দৃশ্য দেখা গেল সন্ধ্যের আলিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ডে।
এ দিন স্বামী বিবেকানন্দ স্বনির্ভর রোজগার যোজনা প্রকল্পে শতাধিক বেকার যুবক মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে ঋণ পেয়েছেন। তাঁদেরই একজন শামুকতলার যুবক প্রণয় দেবনাথ পাঁচ লক্ষ টাকা ঋণ পেয়েছেন। ঋণে রাজ্য সরকারের ৩০ শতাংশ ভর্তুকিও রয়েছে। সহজ কিস্তিতে ঋণের সুবিধাও রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘আমার ছোট মুদির দোকান থাকলেও টাকার অভাবে ব্যবসা বাড়াতে পারছিলাম না। এ বার সে সমস্যা মিটে গেল।’’ ওই গ্রামেরই অরিন্দম দেবনাথ বললেন, ‘‘আগে ঋণের জন্য কত খঘুরতে হয়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই. তবে এবার আবেদন করেই ঋন হাতে পেয়ে গেলাম। এই টাকা দিয়ে কাপড়ের দোকান করে স্বনির্ভর হতে পারব।’’
শহরের বাসিন্দা চন্দন ঘোষ বছর দশেক আগে স্টিল ও লোহার আবাসন ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সে সময় নিজের উদ্যোগে ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে জমি কিনে কারখানা করেছিলেন বলে দাবি তাঁর। আলিপুরদুয়ার জেলা ঘোষণা হওয়ার পরে আশায় বুক বেঁধেছেন তিনিও। তিনি বললেন, ‘‘এতদিন জেলা শিল্পকেন্দ্র জলপাইগুড়িতে ছিল। শিল্প সংক্রান্ত নানা কাজে জলপাইগুড়ি যেতে হত। এখন জেলায় শিল্প কেন্দ্র হয়েছে। এ বার আর ভোগান্তি পোহাতে হবে না।’’ এ দিন মুখ্যমন্ত্রী বেকার যুবকদের হাতে ঋণের টাকা তুলে দেওয়া ছাড়াও কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, সবুজ সাথী-সহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা তুলে দেন। প্রশসানের তরফে জানানো হয়েছে, এ দিন মোট দশ হাজার বাসিন্দাকে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
শুধু সুযোগ সুবিধে বিলি নয়। শোনা গেল অন্য গল্পও। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অমলেন্দু সাহা দাবি করলেন, আগে আলিপুরদুয়ার জেলার শিক্ষকেরা অবসর নিতেন তখন তাঁদের পেনশন পেতে ন’মাস থেকে দেড় বছর দেরি হত। পেনশনের ফাইল তৈরি করে জমা দিতে যেতে হতো প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরে জলপাইগুড়ি বিদ্যালয় পরিদর্শকের দফতরে। তারপরে তদ্বির করার জন্যও আবার পাড়ি দিতে হতো দুশো কিলোমিটারের পথ। নষ্ট হতো একাধিক দিন। গ্রীষ্ম, বর্ষার ভোগান্তি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। ২০১৪ সালে আলিপুরদুয়ার জেলা ঘোষণা হওয়ায় নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন তিনি। এ দিন বললনে, ‘‘গত ৩১ জানুয়ারি অবসর নিয়েছি। আমাকে আর জলপাইগুড়ি যেতে হয়নি। আলিপুরদুয়ারে বিদ্যালয় পরিদর্শকের দফতরে পেনশনের ফাইল জমা দিই। মাস তিনের মধ্যে শুরু হয় পেনশন।’’
তবে বিপরীত ছবিও ছিল। উৎকণ্ঠায় রয়েছেন জেলা আদালতের ভিতরে একটি ক্যান্টিন চালান রঞ্জন মালাকার। মাস সাতেক আগে আইনজীবীদের একাংশের অনুমতি নিয়ে তিনি ক্যান্টিন করেছেন। তবে মহকুমা আদালত এখনও জেলা আদালতে উন্নীত হয়নি। তবে জেলার কিছু দফতর আদালতের আশেপাশে তৈরি হওয়ায় এমনিতেই তাঁর ব্যবসা বেড়েছে বলে দাবি করলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এখন তো আর সরকারি কাজে কাউকে বাইরে যেতে হয় না। এখানেই আসেন। দিন দিন খদ্দেরের সংখ্যা বাড়াছে। সাত জনের কর্ম সংস্থান হয়েছে আমার ক্যান্টিনে।’’ যদিও তাঁর অপেক্ষা জেলা আদালতে উন্নীত হওয়ার। এখনও বিচারপ্রার্থীদের জলপাইগুড়ি যেতে হয়। তিনি বলেন, ‘‘অপেক্ষা করছি কবে জেলা আদালত ঘোষণা হবে। তাহলে ব্যবসা আরও বাড়বে। অনেক বেকার যুবকের আয়ের রাস্তা খুলবে।’’
এমনই নানা আশা-অপেক্ষার কাহিনি ঝরে পড়ল আলোয় সাজানো আলিপুরদুয়ারের প্যারেড মাঠে। আশায় বুক বেঁধেই ঘরে ফিরল জনতা।