পাথর বোঝাই লরি-ডাম্পারের ধুলো মেখেছে গাছের পাতাও। হরিণশিঙা গ্রামের কাছে। ছবি— দয়াল সেনগুপ্ত
মহম্মদবাজার ব্লকের ডেউচা-পাঁচামি অঞ্চলের যা পরিবেশ, তাতে দিনযাপন যতটা সংগ্রামের, ঠিক ততটাই অস্বাস্থ্যকর। কিন্তু, পাথর শিল্পাঞ্চল লাগোয়া জনপদে বসবাসকারী একটা বড় অংশের মানুষ মনে করছেন, এই বেশ ভাল আছেন।
গত সপ্তাহেই মহম্মদবাজারে প্রস্তাবিত খনি এলাকার কিছু সংখ্যক মানুষের হাতে বীরভূম জেলা প্রশাসন পৌঁছে দিয়েছে সরকার ঘোষিত প্যাকেজ। শুরু হয়েছে প্রাক খনি গড়া পর্বের চূড়ান্ত প্রশাসনিক তৎপরতা। কী ভাবে কাজ এগিয়ে নিয়ে যায় যায়, তা নিয়ে খনি গড়ার দায়িত্বে থাকা লোডাল এজেন্সি পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম বা পিডিসিএলের ম্যানেজিং ডিরক্টর পি বি সেলিম মঙ্গলবারই প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বড় অফিস তৈরি হয়েছে পিডিসিএলের। কিন্তু, খনির জন্য ভিটেমাটি ছাড়তে হলে জীবন-জীবিকার কী হবে, তা নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এলাকার মানুষ (বিশেষত আদিবাসী সমাজ)।
এই অবস্থায় আজ, বৃহস্পতিবার সমাজের মোড়লদের ডাকে স্থানীয় হরিণশিঙা মাঠে সরকার ঘোষিত ত্রাণ ও পুর্নবাসন প্যাকেজ নিয়ে আলোচনায় যোগ দেবেন দেওয়ানগঞ্জ ও হরিণশিঙা গ্রামের আদিবাসীরা। এই দুই এলাকা থেকেই প্রথম ধাপে খনি গড়ার কাজে শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু, আলোচনায় যাওয়ার আগে এলাকার ৮০ শতাংশ মানুষ জানেন না, ঠিক কী রয়েছে ওই প্যাকেজে। কারণ প্রশাসনের উদ্যোগে এলাকার মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে ওই প্যাকেজের প্রতিলিপি এলেও, তা বাকিদের অজানা। প্যাকেজ নিয়ে বিশেষ প্রচারও চলেনি। বীরভূমের জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, ‘‘শীঘ্রই প্রতিটি পরিবারে প্যাকেজে সংক্রান্ত লিফলেট বিলি করা হবে।’’ বুধবার হিংলো পঞ্চায়েতের হরিণসিংহা, কেন্দ্রপাহাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, তেঁতুলবাঁধপাড়া-সহ পাশাপাশি প্রতিটি আদিবাসী গ্রামে প্রস্তাবিত প্যাকেজ নিয়ে বাড়ি বাড়ি প্রচারও করেছেন তৃণমূলের স্থানীয় জন প্রতিনিধিরা।
কিন্তু, মানুষের উৎকণ্ঠা তাতে দূর হচ্ছে কি?
খনি শুরু হওয়ার কথা দেওয়ানগঞ্জ, হরিণশিঙা ও নিশ্চিন্তপুর মৌজার খান পাঁচেক গ্রামে। অনেকেরই প্রশ্ন, প্যাকেজে চাকরির কথা বলা হয়েছে। প্রত্যেক পরিবার কি সেই সুযোগ নিতে পারবে? জমিহীন, ভাগচাষি দরিদ্র বাসিন্দাদের কী হবে? যাঁরা আজ আলোচনা ডেকেছেন, সেই মাঝি হাড়ামদের (মোড়ল) অন্যতম, হরিণশিঙা গ্রামের জোশেফ মারান্ডি । তাঁর কথায়, ‘‘আলোচনা এখনও হয়নি। তাই এলাকার বড় অংশের মানুষ কী চাইছেন, জানি না। তবে আমার ব্যক্তিগত মত জানতে চাইলে বলব, কয়লা খনি চাই না। কারণ, জমি জঙ্গল চলে গেলে আদিবাসী মানুষ বাঁচতে পারবে না।’’
একই রকম দোলাচলে দেওয়ানগঞ্জ মৌজার তালবাঁধ গ্রামের মোড়ল বেচারাম টুডু। তিনি বলেন, ‘‘জমি-জায়গা, গরু-বাছুর সব নিয়ে ভাল আছি। জমির বিনিময়ে টাকা আর ৬০০ বর্গফুটের বাড়ি দিলে কি এ ভাবে বাঁচা যাবে? প্রান্তিক মানুষগুলো আরও সমস্যায় পড়বে।’’ ওই গ্রামেরই যুবক সোমলাল টুডুর সংশয়, ‘‘চাষটুকু ছাড়া তো কিছুই জানি না। কয়লা খনির জন্য ছিন্নমূল হয়ে বাঁচতে পারব না।’’
আবার দেওয়ানগঞ্জ গ্রামের মোড়ল রবিলাল টুডু ইতিবাচক। বললেন, ‘‘শেষ কথা বলবে মানুষ। আগে অলোচনা তো হোক। কারণ, এই প্রকল্প অনেক বড়। কর্মসংস্থানের প্রচুর সুযোগ।’’ হরিণশিঙা গ্রামের বাসিন্দা অসিতবরণ দত্ত বলছেন, ‘‘কাছাকাছি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল নেই। আমার দুই মেয়েই খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করছে। কী আছে এখানে আমাদের জন্য? বরং ভাল প্যাকেজ পেলে নিশ্চয়ই সরে যাব।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বধূও বললেন, ‘‘ভাল ভাবে বাঁচতে পারলে কেন এখানে থাকব?’’
সব মিলিয়ে খনি নিয়ে দুই মতই উঠে আসছে ডেউচায়।