সীমান্তবর্তী গ্রাম গোঁসাইপুরের দৈনন্দিন জীবনে জড়িয়ে রয়েছে বিএসএফ। পাচার রুখতে তাঁদের হেনস্থা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। ছবি: অমিত মোহান্ত।
সীমান্তরক্ষী বাহিনীকেই এখন ভয় করছে গোঁসাইপুর।
দক্ষিণ দিনাজপুরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের গোঁসাইপুর এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নেই। উন্মুক্ত সীমান্ত পথ দিয়ে এলাকার কিছু লোকজন ওপারে চোরাকারবারের সঙ্গে যুক্ত বলে আর পাঁচটা সীমান্ত এলাকার মতোই এখানেও অভিযোগ রয়েছে। সাইকেল, জিরে, গরু, নেশার ওষুধ পাচার রোধে বিএসএফ সীমান্ত পোস্টের পাশাপাশি এখন গ্রামের চাষ জমির মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দেয়। আর তাতেই এলাকার বাসিন্দাদের অস্বস্তি বাড়ছে। তাঁদের দাবি, চোরাপাচার বন্ধ করার নামে বিএসএফ উঠোনেও চলে আসছে।
এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিএসএফ চোরাচালান রোধের নামে নিত্য নিরীহ বাসিন্দা থেকে ছাত্রছাত্রীদের হেনস্থা করছে। সবুজসাথী প্রকল্পের সাইকেল নিয়ে স্কুল ও টিউশন নিতে যাতায়াতের পথে আটকে বইয়ের ব্যাগ তল্লাশি করে কটু মন্তব্য করে বলে এলাকার একাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেছেন।
বাসিন্দারা বলেন, সব সময় পকেটে ভোটের পরিচয়পত্র রাখতে হয়। জেরক্স কপি দেখালে গ্রামে ঢোকা বন্ধ। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রীদের প্রতি একাংশ জওয়ানের ওই বাড়াবাড়িতে আপত্তি জানানো হলেও কাজ হয়নি। তাই এরকম একটি ঘটনা হওয়ারই ছিল বলে বাসিন্দারা মনে করছেন।
তল্লাশির নামে যে কোনও সময়ে গায়ে হাত পড়ার ভয়ে সিটিয়ে আছে গোটা গোঁসাইপুর গ্রাম। সকালে উঠে স্কুলে যাতায়াতের সময় ছাত্রীদের একাংশকে তল্লাশির মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ। সপ্তম শ্রেণীর স্থানীয় এক ছাত্রীর আত্মহত্যার অভিযোগের ঘটনায় সীমান্তের এই গ্রামে বিএসএফের একাংশের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ সামনে এসেছে। রবিবার এলাকায় পা রাখতেই গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, এ রকম আর কত দিন চলবে? মেয়েদের তল্লাশি কেন পুরুষ জওয়ানেরা করবেন? সে সময় কেন মহিলা জওয়ান রাখা হবে না? কাঁটাতারবিহীন ওই গোঁসাইপুর এলাকায় মানবধিকার যেন পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
অথচ বিএসএফ সূত্রের খবর হিলি ক্যাম্পে মহিলা জওয়ান রয়েছে। ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে পুরো বিষয়টি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে চিঠি দিয়ে জানাতে উদ্যোগী হয়েছেন এ জেলার সাংসদ অর্পিতা ঘোষ। এদিন কলকাতার বাড়িতে বসে অসুস্থ বালুরঘাটের সাংসদ অর্পিতা ঘোষ বলেন, ‘‘এর আগেও হিলি এলাকায় গ্রামবাসীদের উপরে বিএসএফের একাংশের অত্যাচারের অভিযোগ নিয়ে সংসদে বক্তব্যের মাধ্যমে নজরে এনেছিলাম। এবারে তো অভিযোগ ভয়ঙ্কর। জেলা পুলিশ সুপারের কাছ থেকে মৃতা ছাত্রীর বাবার অভিযোগের কপি চেয়েছি। রাজনাথজীকে সব জানাবো।’’
তবে বিএসএফ দাবি করেছে, এই ঘটনার জন্য দায়ী ওই ছাত্রীর মা-ই। তিনি বকাঝতা, চড় মারায় ওই ছাত্রী আত্মঘাতী হয়েছে। বিএসএফ সূত্রে দাবি করা হয়েছে, প্রকাশ্যে মাঠের মধ্যে কোনও কিশোরীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন।
কিন্তু এ দিন এলাকায় যেতেই সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রীর মৃত্যু ঘটনাকে সামনে রেখে গ্রামের নবম ও দশম শ্রেণীর কিছু ছাত্রী এগিয়ে এসে বিএসএফের বিরুদ্ধে একাধারে হতাশা ও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাদের অভিযোগ, স্কুলে ও গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে যেতে, বিয়ে এবং অনুষ্ঠান বাড়িতে যাওয়া-আসার পথে সব সময় তল্লাশির মুখে পড়তে হয়। সঙ্গে আসল ভোটার কার্ডের বদলে ভুল করে ভোটার কার্ডের জেরক্স কপি দেখালে কটু মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া হয়। ইভটিজিংও করা হয় বলে অভিযোগ তুলে ছাত্রীদের দাবি “আমাদের সকলের নাম দিয়ে লিখে দিন, বিএসএফ অত্যাচার করছে।”
ঘটনায় জেলার মহিলা সমিতির নেত্রীরাও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির জেলা সভানেত্রী মাফুজা খাতুন বলেন, ‘‘দেশ রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের উপর, তাঁদের একাংশ এমন কাজ করলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবেন? আমরা মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে আইনি সহায়তার প্রয়োজন হলে ওই পরিবারকে সাহায্য করব।’’ এক-দুদিনের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে তাঁরা দেখা করবেন বলে জানিয়েছেন। নিখিলবঙ্গ মহিলা সমিতির জেলা সভানেত্রী সুচেতা বিশ্বাসের অভিযোগ, ‘‘বিএসএফ পাচার রোধের নামে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের হেনস্থা করে বলে অভিযোগ উঠেছে। আমরা বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়ে অভিযুক্ত জওয়ানের শাস্তি দাবি করছি।’’
কাঁটাতারহীন গোঁসাইপুর গ্রামটি সীমান্তের জিরো পয়েন্ট লাগোয়া। এলাকার চকগোপাল ফাঁড়ি পেরিয়ে ওই গ্রামে ঢুকতে হয়। সীমান্ত সড়ক এবং আশপাশের এলাকা ও চাষের জমিতে ফাঁড়ির জওয়ানেরা দিনরাত পাহারায় থাকেন। হিলি ব্লক সদর থেকে হাসপাতাল, স্কুল এবং ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে যাবতীয় কাজে গোঁসাইপুরবাসীকে ওই ফাঁড়ির প্রহরারত জওয়ানদের নজরদারি ও তল্লাশির সামনে পড়ে যাতায়াত করতে হয় বলে অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, ‘‘চাষের কাজ হোক কিংবা মাঠে গরু চড়ানো। সঙ্গে ভোটের পরিচয় পত্র না থাকলেই বিপদ। গ্রামে ঢোকা-বেরনো বন্ধ। পাশের গ্রামে ফুটবল খেলতে গেলেও কিশোরদের পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। নিজ ভূমে পরবাসী হয়েই আমরা রয়েছি’’ বলে বাসিন্দারা আক্ষেপ করেন। গ্রামটিতে ৩৬৭ ঘর মানুষের বাস। ভোটার সংখ্যা ৭৪৫ জন। কৃষিকাজ প্রধান জীবিকা। এলাকার পাঞ্জুল গ্রাম পঞ্চায়েত সিপিএমের প্রধান সন্ধ্যা মালি বলেন, ‘‘দুর্ভোগের বিষয়ে ব্লক কর্তৃপক্ষ এবং থানার পুলিশকে আগেই জানিয়েছি।’’ কোনও কাজ হয়নি বলে তাঁর অভিযোগ।
স্থানীয় ফাঁড়ির অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ড্যান্ট অলোক সিংহ নেগি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে বিএসএফের এক আধিকারিক বলেছেন, ‘‘ছাত্রীদের তল্লাশির নামে গায়ে হাত দেওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। সে রকম তল্লাশির প্রয়োজন হলে মহিলা বিএসএফ জওয়ানদের আনা হয়। তা ছাড়া ছোটখাটো বিষয়ে জওয়ানেরা গ্রামবাসীদের ছাড় দেন।’’
সেই সঙ্গেই তাঁর অভিযোগ, পাচারকারীদের একাংশ স্কুল পড়ুয়াদের কাজে লাগায়। তিনি জানান, ব্যাগ খুলে পরীক্ষা করা ছাড়া কারও গায়ে হাত দেওয়া হয় না। পারিবারিক ঘটনায় ছাত্রীর মৃত্যুকে সামনে রেখে চোরাকারবারীদের একাংশ বিএসএফ জওয়ানদের চাপে ফেলে বদনাম করতে চাইছে। তাতে ঢিলেঢালা পাহারায় কারবার চালাতে সহজ হয় বলে ওই আধিকারিক দাবি করেছেন।