অশোক মডেলে ফের উলটপুরাণ শিলিগুড়িতে

সেই ‘শিলিগুড়ি মডেল’-এ খেলেই ‘দ্বিতীয় ডার্বি’তে ‘টিম-গৌতম’কে জবরদস্ত বেগ দিল ‘টিম অশোক’। গৌতম মানে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। শিলিগুড়ি পুরসভার ‘প্রথম ডার্বি’ জেতার পরে যাঁকে ভোট ময়দানে ফের টক্কর দিলেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী তথা শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:০৯
Share:

দলের দফতরে ভোটের খবর নিচ্ছেন অশোক ভট্টাচার্য। নমিতেশ ঘোষের তোলা ছবি।

সেই ‘শিলিগুড়ি মডেল’-এ খেলেই ‘দ্বিতীয় ডার্বি’তে ‘টিম-গৌতম’কে জবরদস্ত বেগ দিল ‘টিম অশোক’। গৌতম মানে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। শিলিগুড়ি পুরসভার ‘প্রথম ডার্বি’ জেতার পরে যাঁকে ভোট ময়দানে ফের টক্কর দিলেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী তথা শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য। শনিবার শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ভোটে সারাদিনের ঘটনাপ্রবাহ যেন তেমনই ইঙ্গিত দিল।

Advertisement

দিনভর দেখা গেল, কোথাও বিরোধী শিবিরের নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়ে বুথের কাছেপিঠে ঘোরাঘুরি করা ‘বহিরাগত’দের চিহ্নিত করে শাসাচ্ছেন। এলাকা ছেড়ে চলে যেতে দেখা গেল শাসক দলের দাপুটে নেতাদের। কংগ্রেসের পোলিং এজেন্টকে শাসক দল আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখালে দল বেঁধে সিপিএম কর্মীরা গিয়ে পুলিশকে ঘেরাও করেছেন। কোথাও বেচাল (বুথ জ্যাম, ছাপ্পার চেষ্টা) দেখলে কংগ্রেস-বিজেপি-নির্দল-বিক্ষুব্ধ তৃণমূলকে নিয়ে একযোগে চেঁচিয়ে পুলিশ-প্রিসাইডিং অফিসারের কান ঝালাপালা করে দিয়েছেন। সেখানে হস্তক্ষেপে কার্যত বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। আবার কোথাও বিজেপি, কংগ্রেসের ক্যাম্প অফিসে বসে নিছক আড্ডা মারতে দেখা গিয়েছে বাম-কর্মীদের। বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা এক সঙ্গে মাংস-ভাত দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারছেন— চোখে পড়েছে এ দৃশ্যও। রাজনৈতিক সৌজন্যের আপাত কারণ ছাড়াও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট সেখানেও। মাটিগাড়া, ফাঁসিদেওয়া, চটহাট, খড়িবাড়ি— কোথাও ছবিটা আলাদা হয়নি।

শিলিগুড়ি পুর-নির্বাচনে অশোকবাবুর কৌশল ছিল—শাসক-বিরোধী ভোটারদের ভোট দেওয়াটা নিশ্চিত করা, সে তিনি যে দলের সমর্থকই হন না কেন। সেই সূত্র এক জোট করেছিল তৃণমূল বিরোধীদের। মহকুমা পরিষদেও সে ছক বদলায়নি। তৃণমূল-বিরোধী ভোট যাতে ভাগ না হয়, সে জন্য যেখানে বামেদের প্রার্থী নেই বা শক্তি সীমিত সেখানে তৃণমূল-বিরোধী যে দলের সম্ভাবনা রয়েছে তাকেই ভোট দেওয়ার ডাক দেন অশোকবাবু ও সিপিএমের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার। তাই মুখে তৃপ্তি নিয়ে দিনের শেষে অশোকবাবুকে দাবি করতে শোনা গেল, ‘‘তৃণমূলকে রুখতে একজোট হয়ে ফাঁকা ময়দান ছাড়া যাবে না বলে বার্তা দিয়েছিলাম। সাড়া মিলেছে।’’

Advertisement

এ বারই আসানসোল বা বিধাননগরে পুরভোটের প্রচারে গিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, ‘‘শিলিগুড়ির মানুষ সাহস করে লড়ছেন। তাঁরা চান, পাশে আপনারাও দাঁড়ান।’’ কিন্তু এ দিন বর্ধমানের জামুড়িয়া বা খড়্গপুর গ্রামীণের বিচ্ছিন্ন এলাকা বাদ দিলে শাসক দলের মহড়া নেওয়ার নজির দেখা যায়নি। ভোটের আগে তৃণমূলকে ‘সূচ্যগ্র’ জমি না ছাড়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে তড়পানো ‘সিটিজেন্স ফোরাম’ প্রতিরোধ গড়ায় সফল হয়েছে, এমন অভিজ্ঞতা হয়নি বিধাননগরবাসীর। সেখানে মহকুমা পরিষদেও ‘শিলিগুড়ি মডেল’ কাজে আসার রসায়নটি কী?

বাম নেতারা বলছেন, ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় আন্দোলনে নেমে গ্রেফতার হয়েছিলেন অশোক-জীবেশ। গত চার বছরে একাধিক স্থানীয় বিষয় নিয়ে রাস্তায় নেমে একাধিক বার গ্রেফতার হয়েছে এই জুটি। নিয়মিত সভা, মিছিলে বাজার গরম করে রেখেছে শিলিগুড়ির। ভোটে হেরেও মাটি কামড়ে পড়ে থেকে উপস্থিতি জানান দেওয়াটাই ‘মডেল’-এর সাফল্যের রসদ।

তবে ভিন্ন মত রয়েছে। সিপিএমের একাংশ বলছে, উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এখনও আলাদা। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাব ২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তনের যে জোয়ার এনেছিল, তার ধাক্কা লাগে শিলিগুড়িতেও। কিন্তু সব বিষয়েই শাসক দলের মত উত্তরবঙ্গে পুরোপুরি খাটে না। গৌতম দেবেরা তেমনই করতে চান অভিযোগে প্রচার চালিয়ে অশোকবাবুরা সাফল্য পেয়েছেন।

এই প্রসঙ্গেই সিপিএমের এক রাজ্য নেতা আবার জুড়ে দিচ্ছেন ‘শিলিগুড়ি মডেল’-এর দক্ষিণবঙ্গে সফল না হওয়ার আর এক কারণ। তাঁর যুক্তি, ‘‘শিলিগুড়িতে অশোকবাবুর মতো সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার লোক রয়েছেন। দক্ষিণবঙ্গে তেমন নেতৃত্বের অভাব সমস্যায় ফেলছে।’’

তবে পুরভোটে শিলিগুড়িতে যে ফল হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি মহকুমা পরিষদে হবে না বলে দাবি করছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী তথা তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা সভাপতি গৌতম দেব। ভোট-পর্ব মিটতে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘কংগ্রেস-সিপিএম অনৈতিক জোট গড়েছে। সামিল হয়েছে বিজেপিও। ওই জোট গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করেছে। একা লড়ার ক্ষমতা নেই। তাই নীতি বিসর্জন দিয়ে হাত মিলিয়েছে।’’

‘‘রাজনীতিতে সেই নীতিই সফল, যা জেতায়,’’ পাল্টা মন্তব্য অশোকবাবুর। তাঁর সংযোজন, ‘‘সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে আওয়াজ তুললে শাসক দল, পুলিশ-প্রশাসনের জারিজুরি যে খাটে না তা শিলিগুড়ি পুরভোটে বোঝা গিয়েছে। এ বার সেই ধারণা জোরদার করা গেল।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement