অযথা রেফার কেন, অভিযোগ খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেই

কার্যত একটি অভিযোগ। আর তাতেই তোলপাড় স্বাস্থ্য ভবন। কারণ অভিযোগটি শুনেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। একে-তাকে সরিয়ে, কার্যত পুলিশের হাতেপায়ে ধরে অভিযোগকারী পৌঁছে গিয়েছিলেন হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িটার সামনে। নবান্নের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বাড়ি থেকে বেরোতেই চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘‘দিদি, কিছু একটা করুন।’’

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায় ও কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৬ ০৪:১৯
Share:

কার্যত একটি অভিযোগ। আর তাতেই তোলপাড় স্বাস্থ্য ভবন। কারণ অভিযোগটি শুনেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী।

Advertisement

একে-তাকে সরিয়ে, কার্যত পুলিশের হাতেপায়ে ধরে অভিযোগকারী পৌঁছে গিয়েছিলেন হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িটার সামনে। নবান্নের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বাড়ি থেকে বেরোতেই চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘‘দিদি, কিছু একটা করুন।’’

সেই চিৎকার শুনে গাড়িতে ওঠার আগে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তাঁকে দাঁড়াতে দেখেই বলতে শুরু করেছিলেন বাঁকুড়ার খাতরার বাসিন্দা সাগর সামন্ত। সেখানে দাঁড়িয়েই সাগরবাবুর পুরো বক্তব্য শোনেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর হাত থেকে অভিযোগের চিঠিটিও নেন। তার পরে কাছে দাঁড়ানো এক অফিসারের হাতে চিঠিটি দিয়ে সঠিক জায়গায় তা পাঠানোর নির্দেশ দেন।

Advertisement

গোটা ঘটনাটা বড়জোর মিনিট খানেকের। কিন্তু তাতেই আপ্লুত সাগরবাবু। তাঁর আশা, মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই তাঁর আবেদনে কান দেবেন।

কী আবেদন জানিয়েছেন তিনি? খাতরার বাসিন্দা সাগরবাবু জানান, পেটব্যথা নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে কলকাতায় এসেছেন তিনি। কারণ খাতরার হাসপাতালের ডাক্তাররা কার্যত তাঁকে না পরীক্ষা করেই জানিয়েছিলেন, তাঁর অসুখটা গুরুতর। কলকাতায় না গেলে তিনি বাঁচবেন না। অ্যাম্বুল্যান্সে চড়ে তাই এ শহরে আসেন তিনি। এখানকার এক মেডিক্যাল কলেজ পরীক্ষা করে জানিয়ে দেয়, হজমের সমস্যা। কয়েকটা ওষুধ লিখেই ছেড়ে দেন ডাক্তাররা। সাগরবাবুর প্রশ্ন, ‘‘আমার বাড়িতে মুমূর্ষু স্ত্রী রয়েছেন। তাঁকে একা রেখে আমাকে কলকাতায় ছুটে আসতে হয়েছে। জেলায় তো এত হাসপাতাল। তা-ও একটা সামান্য চিকিৎসার জন্যও কেন এ ভাবে হয়রান করা হবে?’’

এর আগে হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে মুমূর্ষু রোগীর পরিজন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি পৌঁছে গিয়েছেন, তার পর শয্যার ব্যবস্থা করতে খোদ মুখ্যমন্ত্রী ফোন করেছেন হাসপাতালের সুপারকে, এমন নজির ছিল। এ বার সরকারি হাসপাতালের ‘ভুল’ রেফারাল সিস্টেমের প্রতিবাদেও মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হওয়ার এই ঘটনা জেলা থেকে কলকাতায় রোগী রেফারের প্রক্রিয়া নিয়েই ফের প্রশ্ন তুলে দিল।

সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের তরফে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। তবে বাঁকুড়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রসূন কুমার দাস বলেন, ‘‘বার বার সতর্ক করা সত্ত্বেও কিছু কিছু ডাক্তারবাবু কেন এমন করছেন তা জানি না। রেফার করার যদি সত্যিই প্রয়োজন হত তা বলে বাঁকুড়ার মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো যেত, কলকাতায় কেন?’’

তবে এটি যে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তার প্রমাণ মিলেছে এমন একাধিক উদাহরণে। সম্প্রতি এক মহিলাকে রেফার করে বেকায়দায় পড়েন পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ‘সঙ্কটজনক’ ওই মহিলাকে এসএসকেএমে রেফার করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা তাঁকে পরীক্ষা করে জানিয়ে দেন, রেফার করার মতো কোনও অসুখই তাঁর হয়নি। অথচ রেফার করার আগে ওই মহিলাকে বাইরে থেকে বেশ কিছু দামি ওষুধ-ইনজেকশন কিনতে হয়েছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করাতে হয়েছিল বাইরের ল্যাবরেটরিতে। রিনা দত্ত নামে ওই রোগিণীর মেয়ে বিদিশা দত্ত বলেন, “অন্যের থেকে টাকা ধার নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে রাতে মাকে কলকাতায় নিয়ে যাই। কিন্তু ডাক্তারবাবুরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, মায়ের হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ স্বাভাবিক রয়েছে। কলকাতায় নিয়ে আসার প্রয়োজনই ছিল না।’’ ওই ডাক্তারদের পরামর্শমতো এসএসকেএমেই রিনাদেবীর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। তার রিপোর্টও ছিল স্বাভাবিক। ট্রেনেই তাঁকে ঝাড়গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যান পরিজনেরা। এর পরে শুধু স্বাস্থ্য দফতর নয়, রিনাদেবীর পরিবার অভিযোগ জানায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। এ ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মুখে কুলুপ। স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা ব়়ড় অংশের বক্তব্য, কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলির ওয়ার্ড উপচে রোগীকে ঠাঁই দিতে হয় শৌচাগারের সামনের মেঝেতেও। অথচ জেলা হাসপাতালের শয্যা বহু সময়েই খালি পড়ে থাকে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে কারণ দেখিয়ে জেলার হাসপাতালগুলি রোগীদের কলকাতায় রেফার করে, আদৌ সেটা হাসপাতালে ভর্তি রেখে করার মতো চিকিৎসাই নয়। এক শ্রেণির ডাক্তারের দায় এড়ানোর মনোভাবই এই রোগী রেফারের মূল কারণ বলেও অভিযোগ করেছেন তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, ক্ষমতায় আসার পরে স্বাস্থ্যে ঢেলে টাকা দিচ্ছেন মমতা। চালু হচ্ছে একের পর এক
প্রকল্প। তার পরেও জেলার পরিষেবার এই হাল দুঃখজনক।

দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘কিছু দিন আগে রেফারাল রেজিস্ট্রি তৈরি হয়েছিল। জেলা থেকে কোনও রোগীকে শহরে রেফার করা হলে কেন করা হচ্ছে, তার সবিস্তার বিবরণ ওই রেজিস্ট্রিতে লিখে রাখার কথা। যাতে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনে ওই রোগী রেফারের সিদ্ধান্ত যথাযথ ছিল কি না, তা বিচার করা যায়। চালু হওয়ার পরে মাস কয়েক সেই নিয়ম মানা হয়েছিল। এখন প্রায় কোথাওই তা মানা হয় না। ওই রেজিস্ট্রি ফের চালু করার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।’’

এ ব্যাপারে স্পষ্টতই দ্বিধাবিভক্ত চিকিৎসকেরা। সিপিএম প্রভাবিত চিকিৎসক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস-এর তরফে গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘৩-৪ শতাংশ ক্ষেত্রে হয়তো ডাক্তারের দায় এড়ানো মনোভাব থাকে। বাকিটা তা নয়। জেলায় এমনিতেই ডাক্তারের অভাব। টানা ডিউটি করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন তাঁরা। তার উপরে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই। চিকিৎসায় এক চুল এ দিক-ও দিক হলেই নিরাপত্তার সমস্যা। ডাক্তারদের দোষারোপ করার আগে কর্তাদের এগুলোও ভাবতে হবে।’’ অন্য দিকে, তৃণমূল প্রভাবিত প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সাক্ষীগোপাল সাহার মতে, পরিকাঠামো আগের তুলনায় অনেকে বেড়েছে। কিন্তু কিছু ডাক্তারের মানসিকতা বদলায়নি। তাঁরা সেই পুরনো পরিকাঠামোর দোহাই দিয়েই দায়িত্ব এড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘সংগঠনের তরফে বারবার সকলকে বলছি। কিন্তু তেমন কাজ হচ্ছে না। অকারণ রেফারে মানুষের হয়রানি বাড়ছে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement