এক দিকে শাসকের প্রতি উপাচার্যের আনুগত্য প্রকাশের তাগিদ আর অন্য দিকে পড়ুয়াদের বল্গাহীন বিক্ষোভ— এই দুইয়ের মিশেলে সঙ্কট দেখা দিয়েছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারকে অনেকটাই শাসকের কাছে নজরানা দিয়েছেন, এমন অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠেছে। তারই মধ্যে উপাচার্যের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বশাসনে অনু্প্রবেশের অভিযোগে ফের বিদ্ধ হলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়!
প্রেসিডেন্সিতে বিক্ষোভরত আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেছেন। সেই প্রেক্ষিতে সোমবার প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘‘অনুরাধা লোহিয়া ওখানে উপাচার্য আছেন, উপাচার্য থাকবেন! সবটাই পরিকল্পনা প্রসূত। কতিপয় কয়েকটি ছাত্রের অভব্য আচরণ। বাংলার সংস্কৃতির তারা মাথা হেঁট করে দিচ্ছে!’’ আনন্দপুরে একটি বেসরকারি স্কুলের অনুষ্ঠানে গিয়ে এ দিন পার্থবাবুর আরও মন্তব্য, ‘‘প্রেসিডেন্সির ঘটনা শুধু আমরা দেখছি না, সারা পৃথিবীর লোক দেখছে। ছাত্র আন্দোলনের নামে তারা কতিপয় ছাত্র, কেউ বলছেন উগ্র বামপন্থা। আমরা তো দেখছি একটা অপসংস্কৃতির বহর! সবটাই নজর রাখছি!’’
এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এবং শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীদের প্রতিবাদের ঘটনার সময়েও প্রতিষ্ঠানের স্বশাসনের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছিল শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য তখন বারেবারেই বলে এসেছেন, শিক্ষা ও পঠনপাঠন সংক্রান্ত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ার চূড়ান্ত। কিন্তু নীতি ও আর্থিক বিষয়ে সরকারের কিছু ভূমিকা থাকবেই। এ বার কিন্তু শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়েই অনধিকার চর্চার অভিযোগ শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনছেন শিক্ষা জগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। তাঁদের প্রশ্ন, উপাচার্যের থাকা বা সরে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলতে পারেন আচার্য তথা রাজ্যপাল। সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে উপাচার্যকে নিয়োগ করেছেন আচার্যই। সেখানে শিক্ষামন্ত্রী কেন এই বিষয়ে মন্তব্য করবেন? এর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থার সময় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপাচার্যের পদ থেকে অভিজিৎ চক্রবর্তীর সরে যাওয়ার ঘোষণা করেছিলেন। সেই ঘটনা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে অনভিপ্রেত সরকারি হস্তক্ষেপ। তা হলে কি রাজ্য সরকার সেই ঘটনা থেকে কোনও শিক্ষাই নেয়নি?
প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় যেমন বলেছেন, ‘‘অনুরাধা লোহিয়া প্রেসিডেন্সির উপাচার্য থাকবেন কি থাকবেন না, সেটা শিক্ষামন্ত্রী বলার কে? রাজ্য সরকার বড় জোর সার্চ কমিটি গড়ে দিতে পারে। শিক্ষামন্ত্রীর কথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার হরণের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।’’ শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য পরে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তিনি সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন মাত্র। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনও মন্তব্য করেননি, কোনও ঘোষণাও করেননি। পার্থবাবুর কথায়, ‘‘আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের ইস্তফার দাবি তুলেছে। তা-ই নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। আমি বলতে চেয়েছি, ওই দাবি মেনে নেওয়ার প্রশ্ন নেই।’’ এখানেও অবশ্য প্রশ্ন থাকছে, এই প্রশ্নের উত্তরে আচার্যকেই দেখিয়ে দিতে পারতেন শিক্ষামন্ত্রী। আইনত এবং নীতিগত ভাবে সেটাই উচিত কাজ হতো। কিন্তু তা না করে তাঁর মন্তব্যের মধ্যে হস্তক্ষেপের মনোভাব স্পষ্ট, এমনই মনে করছে শিক্ষা জগতের একাংশ।
পার্থবাবু প্রেসিডেন্সির উপরে ‘নজর’ রাখার যে কথা বলেছেন, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। অমলবাবুরই মন্তব্য, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী নজর রাখবেন কেন? এর জন্য তো আচার্য তথা রাজ্যপাল রয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীর কথা তো সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্রে আঘাত!’’ এই ক্ষেত্রে অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী তাঁর অবস্থানেই অনড়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন খুশি বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য চলবে, তা মেনে নেওয়া যায় না! দরকারে আরও কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে!’’
শিক্ষামন্ত্রী যে আন্দোলনে সংস্কৃতি নষ্ট হওয়ার কথা বলেছেন, এ দিনই সেই বক্তব্যের পাশে এসে দাঁড়়িয়েছে প্রেসিডেন্সিরই মেন্টর গ্রুপ এবং রাজ্যের বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ সংসদ। তৃণমূল সাংসদ সুগত বসুর নেতৃত্বাধীন মেন্টর গ্রুপের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘উপাচার্যের দফতরে ঢুকে মুষ্টিমেয় কিছু পড়ুয়া যে ভাবে তাঁর সম্মানহানি ঘটিয়েছে, তাতে আমরা স্তম্ভিত ও ব্যথিত! এই গুন্ডামি ও বর্বরতার কঠোর ভাষায় নিন্দা করছি’। রাজ্যের ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিবৃতিও বলছে, ‘এ ধরনের ঘটনা শুধু শিক্ষার পরিবেশকেই নয়, রাজ্যের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির বাতাবরণকে নষ্ট করছে’। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরাতে শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সকলকে সংহতি রেখে কাজ করার আবেদন জানিয়েছেন উপাচার্যেরা। আর এর মধ্যেই মেন্টর গ্রুপ মনে করিয়ে দিয়েছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের নীতির উপরে দাঁড়িয়েই উৎকর্ষের লক্ষ্যে অবিচল। যে স্বাধিকার আবার ভাঙার অভিযোগ উঠেছে শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধেই!