সরকারি সম্পত্তি থেকে সিআরপি-র সামনেই খোলা হচ্ছে হোর্ডিং। বুধবার বসিরহাটে।ছবি: নির্মল বসু।
ভয়ভীতি ঠেলে আম-ভোটারেরা যাতে অবাধে ভোট দিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করার জন্যই অনেক আগে থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে। সেই বাহিনীকে কাজে না-লাগিয়ে বসিয়ে রাখলে সংশ্লিষ্ট কর্তাদের রেয়াত করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এই অবস্থায় কোনও ঝুঁকি না-নিয়ে বাহিনী ব্যবহারের রোজকার সচিত্র বিবরণ কমিশনে পাঠিয়ে দিচ্ছে পুলিশ।
সচিত্র বিবরণ মানে ভিডিও-ক্লিপিংস। পশ্চিমবঙ্গে ফি-ভোটেই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বসিয়ে রাখার অভিযোগ ওঠে। গত লোকসভা ভোটে সেটা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে মনে করে বিরোধী শিবির। তাই এ বার ভোট প্রক্রিয়ার সূচনা থেকেই বাহিনী ব্যবহার নিয়ে রাজ্য প্রশাসনকে কড়া বার্তা দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
তাদের হুঁশিয়ারির মুখে ঝুঁকি এড়িয়ে চলছেন থানার ওসি-রা। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিয়ে ‘রুট মার্চ’ করিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না তাঁরা। সেই টহলের ভিডিও তুলে পাঠিয়ে দিচ্ছেন রাজ্য পুলিশের ‘ইলেকশন সেল’-এ। সপ্তাহ শেষে সেই ভিডিও-ক্লিপিংস জমা পড়ছে কমিশনে।
এখানেই শেষ নয়। কবে কোথায় কত ক্ষণ রুট মার্চ হচ্ছে, থানার কোন অফিসারের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় বাহিনী টহল দিচ্ছে— সে-সবও থানার নথিতে তুলে রাখছেন ওসি-রা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক ওসি বলেন, ‘‘মঙ্গলবার জেলার ক্রাইম কনফারেন্সে পদস্থ কর্তারা জানিয়ে দিয়েছেন, কমিশনের নির্দেশ মানতে হবে অক্ষরে অক্ষরে।’’ মঙ্গলবারেই দিল্লি থেকে ভিডিও-সম্মেলন করে উপনির্বাচন কমিশনার সন্দীপ সাক্সেনা জানিয়ে দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বসিয়ে রাখলে তার দায় নিতে হবে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার ও জেলাশাসককে। এবং বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার অভিযোগ উঠলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেও কসুর করবে না কমিশন।
কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহলদারির ফিরিস্তি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে প্রতিদিনের নির্বাচন সংক্রান্ত কাজকর্মের খতিয়ানও পেশ করতে হচ্ছে কমিশনে। গত লোকসভা ভোটে রাজনৈতিক সংঘর্ষের সূত্রে যে-সব মামলা হয়েছিল, সেগুলির বর্তমান অবস্থা, ভোটারদেরকে ভয় দেখানোর অভিযোগ এসে থাকলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কতগুলি গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর হয়েছে, উদ্ধার বা বাজেয়াপ্ত করা অস্ত্রের সংখ্যাই বা কত— এ রকম ২০টি বিষয়ে রোজ রিপোর্ট পাঠাতে হচ্ছে থানাগুলিকে।
কমিশনের কাছে বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, পুলিশকে ঠুঁটো করে রাখায় দুষ্কৃতীরা লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছে। গত চার বছরে রাজ্যে যে-ক’টি ভোট হয়েছে, তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসের পরিস্থিতি তৈরি করেছে শাসক দল। বিধাননগরে পুর নিগমের নির্বাচনে যে-ভাবে পুলিশের উপস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি, তার ছবিও কমিশনের হাতে তুলে দিয়েছেন বিরোধীরা। পাশাপাশি, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘর্ষ নিয়ে রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা রিপোর্টও খতিয়ে দেখেছে কমিশন। প্রশাসনের একাংশ বলছেন, গত ছ’-আট মাসের পরিস্থিতি বিচার করেই কমিশন এ বার ভোট প্রক্রিয়ার শুরু থেকে কড়া পদক্ষেপ করতে চাইছে। পুলিশকে দৈনিক আইনশৃঙ্খলার রিপোর্ট পেশের নির্দেশ তারই অঙ্গ।
ভোটের এক মাসেরও বেশি আগে আধাসেনা টহল শুরু করলেও অভিযোগের স্রোতে ভাটার লক্ষণ নেই। বিধানসভা নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ জানানোর অ্যাপস চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ বেড়েই চলেছে। গত এক সপ্তাহে কমিশনের অ্যাপসে ১৩০০-র বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। সরকার ও প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নালিশ তো আছেই। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষও অভিযোগ জানাচ্ছেন সমানে। প্রচার-লিখনের জন্য দেওয়াল নিয়ে কাজিয়া, পোস্টার লাগানো ও ছেঁড়া সম্পর্কে অভিযোগ যেমন আছে, তার সঙ্গে রয়েছে ভোটারদের সচিত্র পরিচয়পত্রে ভুলের ভূরি ভূরি নালিশ। ভোটার তালিকায় নাম ওঠার পরেও সচিত্র পরিচয়পত্র না-পাওয়ার অভিযোগও কম নয়। মোবাইল ফোনকে হাতিয়ার করেই অভিযোগ আসছে বেশি। তার সঙ্গে থাকছে ছবিও। আর অভিযোগের এই জোয়ার দেখে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের দফতরের কর্তাদের ধারণা, ভোটের দিন যত এগিয়ে আসবে, অভিযোগের বহর ততই বাড়বে। সে-ক্ষেত্রে অ্যানড্রয়েড ফোনধারী সাধারণ মানুষই নির্বাচনী পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় নেমে পড়বেন।
কমিশনের কাছে পরিস্থিতি তুলে ধরার সুযোগ ও প্রযুক্তি আম-আদমির হাতে পৌঁছে যাওয়ায় চুপ করে থাকতে পারছে না পুলিশ-প্রশাসন। আধাসেনা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের তরফে যে চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই, ভিডিও পাঠিয়ে প্রমাণ দেওয়ার হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে।