পুড়ে ছাই পুলিশের গাড়ি। ছবি: পিটিআই।
খালি হয়ে গেল মায়ের কোল। বড়িষা হাই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়া সৌরনীল সরকারের মৃত্যুর ঘটনা ডেকে এনেছে একাধিক প্রশ্ন। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ট্র্যাফিক পুলিশের নিষ্ক্রিয়তারই কি প্রাণ দিয়ে মাসুল গুনল ছোট্ট সৌরনীল? সেই উত্তর পাওয়া যাবে না। কিন্তু প্রশ্নগুলি কিন্তু জ্বলজ্বল করবে বেহালা চৌরাস্তায়। ব্যস্ত ডায়মন্ড হারবার রোড আবার ফিরে যাবে ব্যস্ততার মোড়কে। কিন্তু সৌরনীলের প্রাণ কাড়ল যে গাফিলতি, তার কিনারা হবে কবে? দু’চোখে শূন্যতা নিয়ে হাসপাতালের মর্গের সামনে বসে সে কথাই কি ভাবছিলেন সৌরনীলের মা দীপিকা? জানা যায়নি। যদিও দুর্ঘটনার পরের চিত্র বারে বারে সেই গাফিলতির দিকেই দিকনির্দেশ করে গেল। জন অসন্তোষের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে চোখের সামনে রাজপথে আগুন দেওয়া হয় পুলিশের গাড়ি, বাইক ছাড়াও একাধিক গাড়িতে। বিশাল পুলিশ বাহিনী গিয়েও পরিস্থিতির রাশ নিজেদের হাতে রাখতে না পেরে ফাটায় কাঁদানে গ্যাসের শেল। পাল্টা জনতার ছোড়া পাথরের ঘায়ে আহত হয়েছেন কয়েক জন পুলিশকর্মী। এক মহিলার মুখে পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল গিয়ে লাগে। তাতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। এই ঘটনা পুলিশের প্রতি মনোভাব আরও কঠোর করে স্থানীয় বিক্ষোভকারীদের। সকলের মুখে স্রেফ একটাই কথা, ‘‘পুলিশ সচেষ্ট হলে কখনও এমন ঘটনা ঘটে!’’
শুক্রবার সকালে বাবার হাত ধরে স্কুলের দিকে রওনা দিয়েছিল ছোট্ট সোনাই। বেহালা চৌরাস্তায় সকাল সাড়ে ৬টা নাগাদ মাটিবোঝাই একটি লরি বেপরোয়া গতিতে ছুটে আসছিল। সেই লরিই সজোরে ধাক্কা মারে দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়াকে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। গুরুতর আহত হন বাবা। তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পর স্থানান্তরিত করা হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। এ দিকে দুর্ঘটনার খবর পেয়েই কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হন চৌরাস্তার আশপাশে। শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ। থমকে যায় যান চলাচল। পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে বোঝা মুশকিল হয়ে ওঠে, এটাই কি ব্যস্ত সড়ক ডায়মন্ড হারবার রোড!
এই ঘটনায় ক্ষোভপ্রকাশ করেন খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্ন সূত্রে খবর, মুখ্যসচিবকে ফোন করে কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল তা সবিস্তারে জানতে চান মমতা। তাঁর নির্দেশেই মুখ্যসচিবের ফোন যায় নগরপাল বিনীত গোয়েলের মোবাইলে। এ দিকে যখন প্রশাসনের শীর্ষস্তর থেকে পুলিশের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হচ্ছে, তখন ডায়মন্ড হারবার রোড কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা ইট ছুড়ছেন অকাতরে। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ফাটাচ্ছে কাঁদানে গ্যাসের শেল। ব্যস্ত রাস্তার দু’পাশেই তখন পর পর গা়ড়ির লাইন জমছে। সন্ধ্যায় সৌরনীলের বাড়িতে গিয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। তিনি সৌরনীলের মায়ের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে সান্ত্বনা দেন। পাশে থাকার আশ্বাস দেন। তিনি জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতাও ফোন করেছিলেন সৌরনীলের পরিবারকে। সৌরনীলের বাবা সরোজের চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব রাজ্য সরকার নিয়েছে বলেও জানান অরূপ। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ‘মনিটর’ করছেন বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী।
তবে শুধু সৌরনীলের পরিজন বা ক্ষুব্ধ মমতা নয়, পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভপ্রকাশ করেন সৌরনীলের স্কুলের প্রধানশিক্ষকও। কাঁদতে কাঁদতে তিনি সমস্ত দায়ভার তুলে দিয়েছেন পুলিশের কাঁধেই। যদিও ঘটনাস্থল পরিদর্শনরত নগরপাল বিনীতের দাবি, অতীতের চেয়ে এই রাস্তায় দুর্ঘটনার সংখ্যা কমেছে। সেটা হয়েছে পুলিশ অফিসারেরা সচেতন থাকেন বলেই। পুলিশ সূত্রে খবর, ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়াতে ডায়মন্ড হারবার রোডের উপর একাধিক ড্রপ গেট বসানো হচ্ছে। পাশাপাশি থানায় যাতে সব সময় একজন ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার আধিকারিক উপস্থিত থাকেন, সেই নির্দেশও দিয়েছে লালবাজার।
ও সোনাই, কোথায় গেলি বাবা!
তখন সব শেষ। বিদ্যাসাগর হাসপাতালে মর্গের ভিতর চিরঘুমে ছোট্ট সোনাই। বাইরে সোনাইয়ের ব্যাগ আঁকড়ে ধরে কাঁদছেন অসহায় মা দীপিকা সরকার। ‘অন্ধের ষষ্টি’ সোনাই যে আর কোনও দিন তাঁকে মা বলে ডাকবে না, সে কথা বুঝেও বুঝতে পারছেন না অসহায় মা। যে ছেলে মাকে হাত নে়ড়ে টা-টা করতে করতে স্কুলে গেল, তাকে আর কোনও দিন আদর করা হবে না! কী করেই বা মানবেন মা! রোজ সকালে বাবার হাত ধরে স্কুলে যেত সৌরনীল। শুক্রবারও তেমন বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে মাকে টা-টা করেছিল ছোট্ট সোনাই। আশীর্বাদ করে ছেলেকে বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন মা। পরীক্ষা যে। সেই মায়ের কোল আচমকাই শূন্য হয়ে গেল। হাসপাতালের মর্গে বসে প্রলাপ বকছেন সদ্য ছেলে হারানো মা। কান্না চাপতে পারছেন না। কেবল ধরা গলায় ডেকে চলেছেন সোনাইকে। তিনি বলছেন, ‘‘স্কুল থেকে ফোন করেছিলেন স্যর, ‘সৌরনীলের মা এখনই চলে আসুন।’ আমি বললাম, ‘এখনই যেতে হবে?’ বললেন, ‘হ্যাঁ, এখনই আসুন।’ ভাবলাম কিছু মনে হয় দরকার। ওর বাবা মনে হয় স্কুলের ব্যাগে পেনসিল, রাবার ঢোকাতে ভুলে গিয়েছে। পরীক্ষা তো, তাই পেনসিল, রাবার লাগবে। আমি আবার সব গুছিয়ে নিয়ে রেডি হচ্ছি যাব বলে। তখন ওর বাবা ফোন করে বলছে, আমাদের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সব শেষ হয়ে গেছে।’’
ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী
পথ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেহালায় যে কুরুক্ষেত্র চলছে, তা নজর এড়ায়নি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানেরও। মুখ্যমন্ত্রী হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে ফোন করে তিনি জানতে চেয়েছেন, এমন ঘটনা ঘটল কী করে? সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী গোটা ঘটনায় যে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন মুখ্যসচিবকে। মুখ্যমন্ত্রীর ফোন পাওয়ার পরেই মুখ্যসচিব সোজা ডায়াল করেন নগরপালের মোবাইল নম্বরে। সবিস্তার জানতে চান, বেহালার ঘটনা। জানা গিয়েছে, নবান্নের তরফে খোদ মুখ্যসচিব লালবাজারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছিলেন। প্রয়োজনে দিচ্ছিলেন একাধিক উপদেশ, পরামর্শ।
মমতার ফোন পরিবারকে
শুক্রবার সন্ধ্যার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোন যায় সৌরনীলের পরিবারের কাছে। সৌরনীলের আত্মীয়দের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। মমতা পরিবারকে সমস্ত রকম সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সৌরনীলের বাবা সরোজের চিকিৎসার ভারও রাজ্য সরকার নিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। সৌরনীলের বাড়িতে গিয়ে তার পরিজনদের সঙ্গে দেখা করেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘‘এটা অত্যন্ত দুঃখের ঘটনা। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ওদের বাড়িতে ঢুকে আমার নিজের হাত, পা কাঁপছিল। মুখ্যমন্ত্রী পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওর মা এখনও প্রায় অচেতন অবস্থাতেই রয়েছেন। এ দৃশ্য দেখার পর আমার আর বলার কোনও ভাষা নেই। বাবা হাসপাতালে আছেন। তাঁর সমস্ত দায় এবং দায়িত্ব রাজ্য সরকার নিয়েছে। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী নিজে মনিটরিং করছেন। আমি এখনই স্থানীয় পুর প্রতিনিধি রাজীবকে নিয়ে আবার পিজি হাসপাতালে যাচ্ছি। সব রকম দায়িত্ব রাজ্য সরকার নিয়েছে। পুরো ব্যাপারটাই নিজে মনিটরিং করছেন মুখ্যমন্ত্রী।’’
অকুস্থলে নগরপাল
সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছন কলকাতার পুলিশ কমিশনার (সিপি) বিনীত গোয়েল। নগরপাল বলেন, ‘‘যা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এমনটা নয় যে ওখানে পুলিশ ছিল না বা থাকে না। অতীতের থেকে এই রাস্তায় বর্তমানে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমেছে। সেটা হয়েছে পুলিশ অফিসাররা সচেতন থাকেন বলেই। কিন্তু কেন এই ঘটনা ঘটল, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত করা হবে। ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে, তা-ও নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হবে।’’
পুলিশের তৎপরতা
লালবাজার সূত্রে খবর, পুলিশ এই ঘটনায় ঘাতক লরির চালক এবং খালাসি-সহ মোট ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে। তার মধ্যেই রয়েছেন ঘাতক লরির চালক এবং খালাসি। ঘাতক লরিটিকে হাওড়া থেকে আটক করা হয়। গ্রেফতার করা হয়েছে লরির চালক এবং খালাসিকে। পুলিশ সূত্রে খবর, লরির চালক ৫১ বছরের জয়দেব দত্ত এবং খালাসি ২৭ বছরের সুজিত খানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চালক জয়দেবের বাড়ি বর্ধমান শহরে। খালাসি সুজিতও থাকেন একই জেলায়। পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার এসিজেএম আদালতে তোলা হবে ধৃত দু’জনকে। তাঁদের পুলিশ নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার আর্জি জানাবে।
পুলিশের ‘অ্যাকশন’
আগামী দিনে যাতে ব্যস্ত ডায়মন্ড হারবার রোডে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য ওই এলাকায় ড্রপ গেট বসানোর পরিকল্পনা করেছে পুলিশ। এই ধরনের গেট বসানো হয় মূলত ফুটপাথ এবং রাস্তার সংযোগস্থলে। রাস্তায় সিগনাল লাল হলে তবেই গেট খোলে এবং মানুষ রাস্তা পারাপার করতে পারেন। রাস্তা দিয়ে যখন গাড়ি চলে, তখন ড্রপ গেট বন্ধ থাকে। পুলিশ কর্তারা মনে করছেন, ড্রপ গেটের ব্যবহার সঠিক ভাবে করা গেলে দুর্ঘটনা কমবে। ইতিমধ্যেই একটি ড্রপ গেট বসে গিয়েছে। লালবাজার সূত্রের খবর, থানায় যাতে সব সময় একজন করে অন্তত ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার আধিকারিক উপস্থিত থাকেন, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা সমস্যায় বাহিনী যখন পাঠানো হবে তখন তাতে যেন পর্যাপ্ত সংখ্যায় মহিলা পুলিশ থাকেন, তা-ও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ব্যারাক বা ছাউনিতে যাতে সর্বদা মোট পুলিশকর্মীর সংখ্যার ২৫ শতাংশ কর্মী মজুত থাকেন, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
কাঁদলেন সৌরনীলের শিক্ষকও
দুর্ঘটনার খবর পেয়েই অকুস্থলে ছুটে যান বড়িষা হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষক কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “পুলিশ যদি সচেতন থাকত, তা হলে আমার ছেলেটাকে হারাতাম না।” পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তা এবং বৈষম্যের অভিযোগ তুলে তাঁর সংযোজন, “পাশে অন্য বেসরকারি স্কুলের সামনে ট্র্যাফিক পুলিশ থাকে, ভিড় নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু আমাদের স্কুলের সামনে কেউ থাকে না। আমাদের স্কুলে চারচাকা নিয়ে কেউ পড়তে আসে না। আসে সাইকেল নিয়ে। এই স্কুল থেকে অনেকের সাইকেল চুরি হয়েছে অতীতে, চোর ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’’ বড়িশা হাই স্কুলের অন্য শিক্ষকেরা জানান, তাঁদের স্কুলে প্রায় ১০০০ পড়ুয়া পড়ে। স্কুল শুরুর সময়ে প্রতি দিন যানজট দেখা গেলেও তা সামলাতে ট্র্যাফিক পুলিশের দেখা মেলে না বলে দাবি তাঁদের।
সংবাদমাধ্যমের সামনে ভেঙে পড়ে প্রধানশিক্ষক বলেন, ‘‘এই ঘটনার জন্য পুরো দায় আমি পুলিশকেই দেব। আমরা স্কুলে ঢুকে খবর পাই আমাদের বাচ্চাটিকে পিষে মেরে দিয়েছে। আমরা গিয়ে ওর বাবাকে বিদ্যাসাগর হাসপাতালে পাঠাই। তখনও পুলিশ ছিল না। পুলিশ আসার পর আমরা যখন বলছি, ‘লরিটা মেরে বেরিয়ে গেল, আপনারা ধরতে পারলেন না,’ উত্তরে বলছেন, ‘নম্বর নেওয়া হয়েছে।’ এত বড় ঘটনার জন্য পুলিশের গাফিলতিই দায়ী।’’