ভোট করাল ভজাইরা, পাহারা দিল পুলিশই

টিভিতে ভোটের খবর দেখতে দেখতে চমকে উঠেছিলেন লালবাজারের গুন্ডাদমন শাখার কয়েক জন অফিসার। কারণ তাঁরা দেখলেন, শাসক দলের হয়ে সল্টলেক-রাজারহাট-বাগুইআটি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লালবাজারের নজরে থাকা দক্ষিণ কলকাতার শেখ বিনোদ, কাশীপুরের আনোয়ার, লেকটাউনের হাতকাটা দিলীপ, বেলেঘাটার রাজু নস্কর-রবি নস্করের দলবল! নিউটাউনে তত ক্ষণে অবশ্য নেমে পড়েছে ভজাই সর্দারের বাহিনী।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:১৪
Share:

চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দিল পুলিশ। রাজারহাটের কাদিহাটি বুথে। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।

টিভিতে ভোটের খবর দেখতে দেখতে চমকে উঠেছিলেন লালবাজারের গুন্ডাদমন শাখার কয়েক জন অফিসার। কারণ তাঁরা দেখলেন, শাসক দলের হয়ে সল্টলেক-রাজারহাট-বাগুইআটি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লালবাজারের নজরে থাকা দক্ষিণ কলকাতার শেখ বিনোদ, কাশীপুরের আনোয়ার, লেকটাউনের হাতকাটা দিলীপ, বেলেঘাটার রাজু নস্কর-রবি নস্করের দলবল! নিউটাউনে তত ক্ষণে অবশ্য নেমে পড়েছে ভজাই সর্দারের বাহিনী। ভোটযুদ্ধে দেখা যাচ্ছে নিউ ব্যারাকপুর, দমদমের দাগি দুষ্কৃতীদেরও।

Advertisement

ভোট করাতে তৃণমূল বাইরে থেকে লোক জড়ো করছে, এমন খবর কয়েক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু সেই বহিরাগত সমর্থকের দলে বাইরে থেকে এমন ভাড়া করা গুন্ডাবাহিনীকে নিয়ে আসা হবে, তা বোধহয় ভাবতে পারেননি সল্টলেক-বাগুইআটির অনেক বাসিন্দাই। কেউ কেউ আশা করেছিলেন, পুলিশ বোধ হয় কিছুটা হলেও সক্রিয় থাকবে। সেই আশাও মাঠে মারা গিয়েছে। বাগুইআটির এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘সক্রিয় তো দূরস্থান, পুলিশ তো দুষ্কৃতীদের কার্যত মদতই দিল এ দিন।’’

এ দিন সকালে কাদিহাটির কালীনাথ স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, বুথের পাহারায় এক চেয়ারে বসে লাঠিধারী পুলিশ। পাশে চেয়ারে বসে তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়েছেন এক তৃণমূল নেত্রী। ওই এলাকার আর কয়েকটি বুথে পাহারাদার পুলিশদের কেউ কেউ গাছের ছায়ায় ঝিমোচ্ছেন। তা হলে ভোটের দায়িত্বে রয়েছে কে? ভোটারদের স্লিপ পরীক্ষা করছিলেন শাসক দলের কর্মীরা। বেশির ভাগকেই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। এবং তাঁদের হয়ে ভোট দিয়ে দিচ্ছিলেন বহিরাগতরা। যাঁদের অনেকেরই বাড়ি ভাঙড়, টালিগঞ্জ, রাজাবাজার এলাকায়। কোনও কোনও পরিচিতকে অবশ্য ভোট দিতে দিলেও দায়িত্ব নিয়ে বোতাম টিপিয়ে দিয়েছেন তৃণমূলকর্মীরা।

Advertisement

রাজারহাট-নিউটাউনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডেই এ বার দাঁড়িয়েছেন সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে আসা তাপস চট্টোপাধ্যায়। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের নিরিখে এই ওয়ার্ড বিশেষ সংবেদনশীল বলেই ভাড়া করে আনা হয়েছিল টালিগঞ্জের এক দাগি দুষ্কৃতীকে। ২ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্ব নিয়েছিল সে। ভোটের পরে ওই দুষ্কৃতী তার ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছে, ‘‘অপারেশন সাকসেসফুল।’’

যেমন ২১ নম্বর ওয়ার্ডে চামেলি নস্করের হয়ে সকাল থেকেই ভোট করাতে নেমেছিলেন ২ নম্বর জ্যাংড়া পঞ্চায়েতের প্রধান শিবু গায়েন ও তাঁর দলবল। ভিড় যতই কম থাক, লাইন এগোচ্ছিল না। প্রমোদগড় স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে এক জন ভোটার গজগজ করছিলেন, ‘‘আধ ঘণ্টা হয়ে গেল! লাইন নড়ছে না।’’ ভিতরে কিন্তু পিঁক-পিঁক করে ইভিএমের শব্দ আসছে! ওই এলাকায় অবশ্য সুমন্ত বর নামে এক পুলিশ অফিসারের দাপটে শাসক দলের কর্মীরা কিছুটা পিছু হটছিলেন। দুপুরে হঠাৎই ডিউটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় সুমন্তকে। তার পরেই ২১ নম্বর ওয়ার্ড জুড়ে শুরু হল ভোট-লুঠ।

তৃণমূলেরই একাংশ বলছে, পুলিশের রাশ আলগা হতেই নিউটাউনের সিন্ডিকেট মাফিয়া ভজাই সর্দারের দলবল সেখানে নেমে পড়েছিল। বেলা এগারোটা বাজতেই বাগুইআটিতে নেমে পড়েছিল ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী। একের পর এক ভোটকেন্দ্রে ঢুকে পিটিয়ে বিরোধী শূন্য করেছে তারা। তার পর ফাঁকা ময়দানে ভোট লুঠ হয়েছে। পুলিশের গা-ছা়ড়া মনোভাবের সুযোগেই বহিরাগত দুষ্কৃতীরা গুলি চালিয়েছে কৈখালিতে। নোয়াপাড়ায় পাঁচ সশস্ত্র দুষ্কৃতীকে পাকড়াও করার পরে বাম কর্মীরা বললেন, ‘‘পুলিশ ছিল না বলেই ধরতে পারলাম।’’

পুলিশ তা হলে কী করল?

বাগুইআটি, কেষ্টপুর এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ভোটকেন্দ্রের বাইরে দাঁড়ানো পুলিশ-হোমগার্ডেরা কার্যত শাসকদলের বহিরাগতদের পাহারা দিয়েছে। এবং বিকেলে কৈখালিতে গুলি চলার পরে পুলিশ ছুটে এসেছে। সেখানে এসেই বাগুইআটি থানার আইসি সুকোমলচন্দ্র দাস কলার টেনে ধরেন ভোটকেন্দ্রের বাইরে দাঁড়ানো কংগ্রেস প্রার্থী দেবরাজ চক্রবর্তীর। তাঁর পকেটের পেন কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘‘পেন ক্যামেরায় ছবি তোলা হচ্ছে!’’ সেটি আছড়ে ভেঙেও ফেলেন। দেবরাজকে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।

বিধাননগর কমিশনারেটের কর্তারা দাবি করেছেন, ভোটের শেষে ৫৩ জন বহিরাগতকে পাকড়াও করা হয়েছে। ভোটের শেষে। আগে নয়!

পড়ুন: পাছে দাপট কমে যায়, শাসকের ভরসা তাণ্ডবে

পড়ুন: বেঁচে ফেরার অভিজ্ঞতা

পড়ুন: দিনভর চলল ‘ভোট-লুঠ’, সব দেখেও সুশান্ত শান্তই

পড়ুন: ভোট দেওয়াই হল না, গেরো রহস্যের মেরো

পড়ুন: সাংবাদিক নিগ্রহের নিন্দা, গ্রেফতারির দাবি

পড়ুন: এ রকম ‘পিসফুল’ ভোটই ভাল, তাই না!

পড়ুন: ইহারা জননীর গর্ভের লজ্জা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement