(উপরে) ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। ২০২৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি (নীচে)। —ফাইল চিত্র।
কালীঘাট থেকে লাউডন স্ট্রিট। সেখান থেকে সোজা মেট্রো চ্যানেল। সেই দিনটা ছিল রবিবার। বিকেলবেলা। ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯। তার খানিক ক্ষণ আগে শেষ হয়েছে বামেদের ব্রিগেড সমাবেশ। তার মধ্যেই খবর চাউর হল, কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের লাউডন স্ট্রিটের বাংলো ঘিরে ফেলেছে সিবিআই। চিটফান্ড মামলার তদন্ত সূত্রে কমিশনারের সরকারি বাসস্থানে হানা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
তৎক্ষণাৎ দু’টি ঘটনা ঘটেছিল। এক, শেক্সপিয়র সরণি থানার পুলিশ গিয়ে সিবিআই অফিসারদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়, তার অব্যবহিত পরেই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজীবের বাংলোয়।
সেখান থেকে পুলিশকর্তা এবং সরকারি আমলাদের নিয়ে সটান মেট্রো চ্যানেলে ধর্না শুরু। টানা তিন দিন চলেছিল সেই ধর্না। যত দিন না রাজীব সুপ্রিম কোর্ট থেকে ‘রক্ষাকবচ’ পেয়েছিলেন। বিরোধী নেত্রী হিসেবে ধর্না, বিক্ষোভ এবং অবস্থান বরাবর তাঁর আন্দোলনে থেকেছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম বার ধর্না দিয়েছিলেন মমতা। তার ঠিক পাঁচ বছর পর ২০২৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারিও মমতা সেই ধর্নামঞ্চেই। তবে এ বার রেড রোডে। অম্বেডকর মূর্তির পাদদেশে। সে বার মমতার প্রতিবাদ ধর্নার বিষয় ছিল কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে রাজ্য পুলিশের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার প্রতিবাদ। এ বারের দাবি ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা, সড়ক যোজনায় বাংলার বকেয়া টাকা পাওয়ার।
বস্তুত, এ বারের ধর্না কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে হলেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধেও সমান ভাবে আক্রমণ শানাচ্ছে তৃণমূল। শুক্রবার বিকেলে ধর্নামঞ্চের বক্তৃতায় মমতা বলেছিলেন, ‘‘ওরা এজেন্সি দিয়ে ভাবছে দেশ দখল করবে, বাংলা দখল করবে, সবাইকে জেলে ঢুকিয়ে মাঠ ফাঁকা করবে। কিন্তু পারবে না। ওরা যত গ্রেফতার করবে, তত ভোট বাড়বে। তার এক দিন এই এজেন্সি যদি ওদের দিকে যায়? তখন কী করবে? বুঝবে ঠ্যালা।’’ গত পাঁচ বছরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ‘সক্রিয়তা’ আরও বেড়েছে। এর মধ্যে তাদের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন মমতার মন্ত্রিসভার দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। গ্রেফতার হয়েছেন তাঁর দলের একাধিক বিধায়কও। আবার এরই মধ্যে রাজনৈতিক ভাবে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করে তৃতীয় বারের জন্য রাজ্যের ক্ষমতা দখল করেছেন মমতা।
গত পাঁচ বছরে এটি হল মমতার তৃতীয় ধর্না। কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে গত বছর মার্চ মাসেও রেড রোডে এই একই জায়গায় দু’দিনের ধর্না-অবস্থান করেছিলেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী। শুক্রবার থেকে এই দফার ধর্না শুরু করেছেন মমতা। শনিবারের পর তিনি ধর্নায় না-থাকলেও কর্মসূচি চলবে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। রবিবার থেকে তৃণমূলের বিভিন্ন শাখা সংগঠন ও জেলা কমিটিকে তারিখ ধরে তার দায়িত্বও বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে।
পাঁচ বছর আগে মমতার মেট্রো চ্যানেলের ধর্নার সঙ্গে এ বারের ‘মিল’ অনেক। আবার ‘অমিল’ও বিস্তর। মেট্রো চ্যানেলের ধর্নামঞ্চের পিছনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছিলেন। সেই সময়ে রাজ্য বাজেট ছিল। এ বারও সামনে রাজ্য বাজেট রয়েছে। এ বারেও ধর্নামঞ্চের পিছনে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক কাজের জন্য অস্থায়ী অফিস তৈরি হয়েছে। মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে বাজেট সংক্রান্ত কাজকর্ম করে আসছেন তিনি। পাশাপাশি করছএন সাংগঠনিক বৈঠকও। পাঁচ বছর আগে রাজীব ছিলেন কলকাতা পুলিশের সর্বেসর্বা। এখন তিনি রাজ্য পুলিশের সর্বেসর্বা।
মাঝে অবশ্য গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। রাজীব একটা বড় সময় তথ্যপ্রযুক্তি সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। পুলিশ থেকে আমলা হয়ে গিয়েছিলেন রাজীব। তাঁকে সারদাকাণ্ডে জেরা করেছে সিবিআই। শিলংয়ে তাঁর মুখোমুখি বসানো হয়েছিল তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষকে। মাঝে কুণাল-রাজীবের যে ‘তিক্ততা’ তৈরি হয়েছিল, আপাতদৃষ্টিতে তা অনেকটাই কেটেছে। এসেছে সৌজন্য বিনিময়। তবে পাঁচ বছর আগে মমতার ধর্নার সময় কুণাল ছিলেন তৃণমূলের বৃত্তের বাইরে। এখন তিনি দলের ‘অলিখিত’ প্রধান মুখপাত্র।