—ফাইল চিত্র।
রাতে হঠাৎ সাইরেনের শব্দে ঘুম ভেঙে ছিল সেই দিন। তত ক্ষণে ভেসে গিয়েছিল গোটা শহর। ঘরের ভিতর জলে থইথই। পাড়ায় পাড়ায় তখন অন্ধকারে ভেসে আসছে প্রিয়জনের নাম ধরে ডাকা হাহাকার। দেওয়াল ধসে কেউ চাপা পড়ে গিয়েছেন, কেউ আবার জলের তোড়ে ভেসে কোনও দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে নিথর হয়ে গিয়েছেন! ১৯৬৮ সালের লক্ষ্মীপুজোর আগের রাতে জলপাইগুড়ি শহরের গলি থেকে রাজপথ সব গ্রাস করেছিল তিস্তার বাঁধ ভাঙা জল। যার পরিণতিতে সেই শহরের চেহারাটাই বদলে গিয়েছিল। ৫৫ বছর আগের সেই ৪ অক্টোবরের স্মৃতি বুধবার ফিরল জলপাইগুড়িবাসীর মনে।
১৯৬৮ সালের সেই ভয়াবহ বন্যার কথা বলতে গিয়ে জলপাইগুড়ি সদরের বাসিন্দা বছর সত্তর ছুঁই ছুঁই গৌরীশঙ্কর সরকার বলেন, ‘‘১৯৬৮ সালের ৪ অক্টোবর লক্ষ্মী পুজোর আগের দিন ছিল। ঘরে ঘরে পুজো আয়োজনের তোড়জোড় চলছিল। সেই সময় তিস্তার হড়পা বান গোটা জলপাইগুড়ি ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমার বয়স তখন খুবই কম। সে কী জলের স্রোত! সেই তিস্তাকে সামাল দেওয়ার ক্ষমতা কারও ছিল না। ঘরে ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল আমাদের। এত বছর পর আবার সেই তিস্তাকে দেখছি!’’
সরকারি নথিতেও ১৭৮৭ সালে জলপাইগুড়ি শহর এলাকায় বন্যার বিবরণ হয়েছে। তখনও অবশ্য শহরের প্রতিষ্ঠা হয়নি। শহর প্রতিষ্ঠার পরে ১৮৮১ সালে প্রথম বন্যার তথ্য পাওয়া যায়। সেই হিসেবে শহর গড়ে ওঠার আগে থেকে এখনও পর্যন্ত অন্তত ২০টি বড় আকারের বন্যার তথ্য রয়েছে। যার মধ্যে ১৯৬৮ সালের বন্যাই ভয়াবহতম বলে জানা যায়। ওই বছর ২ অক্টোবর থেকে অস্বাভাবিক বৃষ্টি শুরু হয়েছিল তিস্তার উচ্চ অববাহিকায়। চলেছিল ৫ অক্টোবর পর্যন্ত। তার মাঝে ৪ অক্টোবর ১৯৬৮ সালের গভীর রাতে হঠাৎ শহরে ঢুকে পড়েছিল তিস্তা।
৫৫ বছর আগে ওই দুর্যোগ প্রত্যক্ষ করেছিলেন গৌরীশঙ্করের প্রতিবেশী-বাল্যবন্ধু প্রমোদ সাহাও। প্রমোদের কথায়, ‘‘সেই সময় জলপাইগুড়ি শহর অনেক ছোট। অধিকাংশ বাড়িই একতলা। টিনের চাল। শহরে বন্যার জল ঢুকেছিল প্রথমে করলা নদী দিয়ে। রাত দুটো নাগাদ। তখন করলার মোহনা ছিল কিং সাহেবের ঘাটের কাছে। সেখানে বাঁধ থাকায় জল ঢুকতে একটু সময় নেয়। করলা নদীর উপর যে ক’টি ব্রিজ ছিল, একটি বাদে সব ক’টি ভেঙে গিয়েছিল। ফলে করলার পূর্ব দিকের অংশ পশ্চিম দিকের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। একই সঙ্গে রংধামালীর দিক থেকেও প্রবল বেগে ঢুকেছিল তিস্তার জল। গোটা শহরটা দুই থেকে সাড়ে চার মিটার জলের তলায় চলে গিয়েছিল। শুনেছি জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের একতলাটিও সম্পূর্ণ ডুবে গিয়েছিল। অধিকাংশ রোগীকেই বাঁচানো যায়নি।’’
সরকারি হিসাবে, ’৬৮ সালের বন্যায় ২১৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। যদিও বেসরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। হাজারেরও বেশি গবাদি পশুর মৃত্যু হয়। অন্তত সাড়ে তিন হাজার বাড়ি আংশিক অথবা পুরো ভেঙে গিয়েছিল। জলপাইগুড়ি শহরের উত্তরে তিস্তার যে অববাহিকা, তার অধিকাংশই পার্বত্য এলাকা আর কিছুটা হিমবাহ। হিমবাহ অঞ্চলে রয়েছে অনেকগুলি প্রাকৃতিক হ্রদ, যেগুলি প্রচুর জল সঞ্চয় করে রাখতে পারে। সেই রকম হ্রদে ভাঙনের ফলেই বিপুল জলরাশি নীচে নেমে এসে সেই সময় হড়পা বান ঘটিয়েছিল বলে কেউ কেউ বলে থাকেন। এ বার শোনা যাচ্ছে, উত্তর সিকিমের লোনাক হ্রদের উপর মেঘভাঙা বৃষ্টির জেরেই বিপত্তি ঘটেছে। ভেঙে গিয়েছে চুংথাম বাঁধ। তাতেই অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গিয়েছে তিস্তার জলস্তর। সমতলে তিস্তার উপর গজলডোবা বাঁধ (ব্যারাজ) রয়েছে। সেখানকার অতিরিক্ত জল বার করে দিতে খুলে দেওয়া হয়েছে প্রায় প্রতিটি স্লুইস গেটই। তার পর থেকেই আতঙ্কে প্রহর গুনছেন তিস্তাপারের বাসিন্দারা। তিস্তাপারের শ্যামল ঘোষ বলেন, ‘‘গতকাল রাত থেকে গজরাচ্ছে তিস্তা। ওই শো শো শব্দে আমাদের ঘুম উড়ে গিয়েছে। দাদুর মুখে ১৯৬৮ সালের গল্প শুনেছিলাম। এখন নীজের চোখে দেখছি!’’
১৯৬৮ সালের পরেও তিস্তা বহু বার ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়েছে। করলা নদী দিয়ে জল এসে জলপাইগুড়ি শহর ভাসিয়েছে। কিন্তু ’৬৮ সালের মতো ভয়াবহ আকার নেয়নি। এই ৫৫ বছরে জলপাইগুড়ি শহরে বাঁধের সংস্কার হয়েছে, তিস্তার উপর ব্যারেজ হয়েছে যা ওই নদীর জলের একাংশ মহানন্দায় নিয়ে যাচ্ছে। তার পরেও কেন জলপাইগুড়িকে বন্যার ঝুঁকি থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ করা যাচ্ছে না? বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, তিস্তার উচ্চ অববাহিকায় ক্রমাগত নির্মাণ কাজ হচ্ছে। বিপুল পরিমাণে বনভূমি নষ্ট হয়েছে রাস্তা প্রসারিত করার জন্য। তার উপরে তিস্তার বুকে বেশ কয়েকটি ব্যারেজ ও জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সিকিম ও দার্জিলিং হিমালয়ের অন্তর্ভুক্ত তিস্তার উচ্চ অববাহিকা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ওই এলাকায় প্রতিটি জলাধারই ঝুঁকিপূর্ণ। বর্ষাকালে ধস নামার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে সম্প্রতি। একটু বেশি পরিমাণ বৃষ্টি হলেই প্রাকৃতিক জলাশয় এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জলাধারগুলি সেই জল ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। সেই কারণেই বার বার এমন বিপর্যয় ঘটছে বলেই মতে তাঁদের।