অঙ্কন: অর্ঘ্য মান্না
সময়ের অনেকটা আগেই চলে এসেছিলাম এক ভিনদেশ থেকে অন্য ভিনদেশে পাড়ি দেওয়ার বন্দরে। সঙ্গী বলতে খানদু’য়েক বই, আর মুহূর্তসঙ্গী ল্যাপটপ। লাউঞ্জে পাতা চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছিলাম। হাতে এম আর নারায়ণস্বামীর ‘The Tiger Vanquished’। কিলোনেচ্চির গভীর জঙ্গল থেকে জীবনের একেবারে শেষ লগ্নে ব্রিটেনবাসী নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে দূরাভাষে শেষ কথোপকথন। আচমকা ঠিক পাশে নিখাদ বাংলায় বেশ শাসানির সুরে মুঠোফোনের কথোপকথন মনটাকে ভিজিয়ে দিল। এত দিন পরে এই পরবাসে প্রাণের ভাষায় ভাব বিনিময়ের এমন পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো সুযোগের লোভে প্রাণে ঝিলিক বয়ে গেল। এক বৃদ্ধা অনর্গলভাবে কার যেন মুণ্ডপাত করে চলেছেন। কথোপকথন শেষ হতেই বৃদ্ধা একেবারে আমারই মুখোমুখি। বেশ শাসনের সুরেই জানতে চাইলেন
— You Indian?
— Yes Mam
—ঘর কাঁহা হ্যায়?
—কলকাতা।
—আমি জানতাম। অনেকক্ষণ ধরেই তোমায় চোখে চোখে রাখছিলাম। মিচকে শয়তান বটে।
হায় রে বিধাতা! এমন বিদেশ বিভঁুইয়ে এসে একেবারে অপরিচিতার কাছ থেকে এমন সম্ভাষণ! এ-ও ছিল আমার অদৃষ্টে! কী বলব তা ভেবে ওঠার আগেই ফের ঝাঁঝালো প্রশ্নবাণ।
— ক’ছেলেমেয়ের বাপ?
— একমাত্র ছেলে।
— তা কোন রাজকার্যে এই বিদেশে?
— আজ্ঞে, পেশাগত কাজে।
—তা কোন পেশার পিণ্ডি চটকাচ্ছ শুনি?
একের পর এক প্রশ্ন। আমি দিশেহারা। পালানোর পথ খুঁজছি। নমস্কার জানিয়ে সবেমাত্র কয়েক পা এগিয়েছি।
— পালিয়ে যাচ্ছ? আমি বাঘ না ভাল্লুক? আমাকে ছেড়ে সবাই পালিয়ে যায়। আমার একমাত্র ছেলেও পালিয়ে গিয়েছে। অথচ দেখো, এই মেয়েটাকে। নিজের মেয়ে না হয়েও সব কাজ ফেলে চলেছে আমার সঙ্গে।
কে যেন আমায় প্রাণপণ টেনে ধরল। আমি নিঃশ্বাস চেপে রেখে পা বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। কিন্তু পা দুটো যেন এই পৃথিবীর চেয়ে ভারী হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পিছন ফিরে তাকালাম। মনে হল, দুটো আর্ত চোখ যেন অনন্তকাল ধরে আমারই প্রতীক্ষায়। আর সেই চোখের সরোবর প্লাবনের ঘনঘটায় কানায় কানায় পূর্ণ। বড় করুণ সেই চোখের জ্যোতি। বড়ো স্নেহাতুর সেই চোখের আকুতি। চার্লস ডিকেন্সের সেই বিখ্যাত লাইনটা কে যেন আমার কানে আউরে যেতে লাগল— ‘the clock began to strike and I began to cry, simultaneously’।
নিজের অজান্তেই মাথাটা নেমে এল। কত দিন পরে কোনও মাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। বুকে জড়িয়ে নিলেন বৃদ্ধা। আর তাঁর চোখের জলের অপার আকুতিতে জুড়িয়ে গেল আমার মনের সকল সন্তাপের আঁচ।
আমার সব খুঁটিনাটি জেনে নিলেন খুব আগ্রহ সহকারে। তিনি বললেন, ‘‘আমার ছেলেটা বেঁচে থাকলে কি এই বুড়ো বয়সে এমন পুণ্যি করতে আসতে হত। ঠাকুর আমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন শুধুমাত্র আমার মরা ছেলের সাধ পূর্ণ করার জন্য।’’
বুঝে নিতে এতটুকুও ভুল হল না, ধমক আর হুঙ্কারের আড়ালে প্রবল ভাবে বয়ে চলেছে এক করুণ ফল্গুধারা। যার দু’কুল বেয়ে কেবলই ঝরে পড়ছে তীব্র বেদনা আর হাহাকার। এই অশীতিপর বৃদ্ধা তাঁর ন্যুব্জ শরীর জড়িয়ে রেখেছেন স্মৃতির মালার সুগন্ধিতে। আর তাঁর মন জুড়ে বয়ে চলেছে সন্তানহারা মায়ের অসহায় আর্তি।
তিনি বলে চলেন, ‘‘বড় দুঃসাহসী ছেলে ছিল আমার। দেশে থাকতে কত পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছে। বিদেশে এসেও। রোমাঞ্চভরা আমাজ়ন ওঁকে নিশিডাকের সুরে ডাকত। খুব ইচ্ছে ছিল ওঁর যাওয়ার। আমাকে বলত, ‘মা আমি যদি কোনও অভিযানে গিয়ে দুম করে মরে যাই, তুমি কিন্তু কাঁতরিনকে নিয়ে অবশ্যই আমাজ়নে যেও। না হলে আমি মরেও শান্তি পাব না।’ বিধাতার কী নিষ্ঠুর পরিহাস! সেই কথাই সত্যি হল! আমার ছেলেটা বড়ো ছটফট করছে এখনও। আমাজ়ন যে ও দেখে যেতে পারল না। ঘুমের মাঝে তাই ও আমায় রোজ দেখে যায়। গাড়ি চালাতেও বড্ড ভালোবাসত। কে জানত, সেই গাড়িই এক দিন কাল হবে!” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁফাচ্ছেন বৃদ্ধা।
বৃদ্ধার সঙ্গিনী তাঁর ফরাসি পুত্রবধূ। তিনি এখন স্বদেশেই থাকেন এবং দ্বিতীয় বার আর বিয়ে করেননি। অকাল বৈধব্যের মাঝেও হয়তো তাঁকে এখনও আবেশ করে রেখেছে আমারই স্বদেশীয় এক তরতাজা প্রাণের জীবন্ত স্মৃতি। তিনি বাংলা বোঝেন, কিন্তু বলতে পারেন না। অন্য দিকে তাঁর শাশুড়ি ফরাসি বোঝেন, কিন্তু বলতে পারেন না। আশ্চর্যজনক ভাবে এই দু’জনের মধ্যে একেবারে দু’টো ভিন্ন ভাষায় কথোপকথন হয়।
কাকতালীয় ভাবে এই দেশান্তরের যানে একই সারিতে আমাদের পাশাপাশি বসার আসন। জানলার পাশের আসনটা আমার হলেও, ওটা ছেড়ে দিয়ে একেবারে প্রান্তের আসনে আমার বসার অনুমতি মিলল। মাঝখানে বৃদ্ধা এবং জানলার পাশে তাঁর পুত্রবধূ। ভাগ্যিস! ফরাসিদের মতো কঠিন ভাষা বোঝার ক্ষমতা এই নিরেট মস্তিকের যে একেবারেই নেই। আর মাঝআকাশে গুগল ট্রান্সলেটরও নেই। আমার ‘চলতা-ফিরতা ফরাসি ডিকশনারি’ শ্রীমান অর্চিস্মানকেও পাওয়া যাবে না। তাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সবেমাত্র দু’চোখ বুজে ভাবনার সমুদ্রমন্থন শুরু করেছি। আবার সেই চিৎকার— ‘কী হে ছোকরা, এই যে বললে তুমি কয়েক রাত টানা জাগতে পার!’
কী কুক্ষণেই যে কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম! আমি এখনও ছোকরা! আর মাত্র কয়েক বছর পরেই অর্ধশতক পার করার কথা! তবু এই ভেবে মনকে আশ্বস্ত করলাম যে, অন্তত দুধের শিশু বলে চিহ্নিত হইনি! অগত্যা আবার কথা শুরু। বৃদ্ধাই বলে চলেছেন তাঁর জীবনের সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান, তাঁর যক্ষের ধন একমাত্র সন্তানের দুঃসাহসিক জীবনকথায় গাঁথা অদম্য উপাখ্যান। কথা চলতে চলতেই চোখ পড়ে গেল সামনের ভিসুয়াল পর্দায়। প্রতি ঘণ্টায় প্রায় হাজার কিলোমিটার গতিবেগে ধেয়ে চলেছি আমরা। নীচে বয়ে চলেছে ‘রাইন’। বৃদ্ধা আবার ভাবনার জগত থেকে ফিরিয়ে আনেন, ‘‘কী এত ভাব বলতো? বাড়ির কথা মনে পড়ছে? বৌমার কথা? ছেলের কথা?’’ বলতে গেলাম, না মাসিমা, ইতিহাসের চুপকথা। কিন্তু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম ধমকের আশঙ্কায়। বৃদ্ধা ব্যাগ থেকে বের করে তাঁর নিজে হাতে তৈরি করে আনা নারকেল নাড়ু আমাকে হাতে করে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘‘আমার ছেলেটা বেঁচে থাকলে ঠিক তোমার বয়সীই হত।’’
আমি আর বসে থাকতে পারছি না। মাগো, তুমি কোথায়? বড় দেখতে ইচ্ছে করছে। তোমার কোলে মুখ লুকিয়ে বড়ো কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বুকের বাঁ দিকের লাল টকটকে যন্ত্রটা কে যেন দুহাতে পাক দিয়ে দিল। আর তা থেকে ক্রমাগত নিঃসৃত হতে লাগলো জীবনের দুঃসহ মুহূর্তের নির্মম অশ্রুধারা। ইনিই তো সেই সন্তানহারা মা, যাঁর দুঃসাহসী সন্তান তাঁকে দুঃখের পারাবারে ডুবিয়ে দিয়ে এখন হয়তো স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে উঠে চলেছেন অনন্ত শান্তিনীড়ের অমৃতের সন্ধানে। ইনিই তো সেই মা, যার দুঃসাহসী সন্তানের অধরা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে এই অশীতিপর শরীর নিয়েও পাড়ি দিতে চলেছেন শ্বাপদসঙ্কুল ভয়াল ভয়ঙ্কর আমাজ়ন অরণ্যে। যানের ছোট্ট জানলার কাচ ফুঁড়ে ছিটকে আসা পড়ন্ত রোদ্দুরের আঁজলা ভরা সোনারঙে এ তবে আমি কার মুখ দেখি!
সেই কোন ছেলেবেলায় মহাষ্টমীর সকালে পুষ্পাঞ্জলি দিতে গিয়ে জগৎজননী মহামায়ার চোখ চেয়ে বিড়বিড় করতাম, ‘‘ঠাকুর, আমার মাকে ভাল করে দাও... ঠাকুর আমার মাকে কোনও কষ্ট দিও না...।’’ বুকের মধ্যে সহস্র কোটি ঢাকের আওয়াজ। বলতে বলতে ঘোর ভাঙত যখন আশ্বিনের শিশিরের মতো শব্দহীন কি যেন টুপ করে পড়ত আমারই হাতে গচ্ছিত রাখা শিউলি ফুলের কপালে! জল! হবে হয়ত!
আমাদের যাত্রাপথ ভাগ হয়ে যাবে এ বার। হয়তো চিরতরে। ওঁরা যাবেন পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে সবথেকে রোমহর্ষক জঙ্গলের আদিমতার ঝর্ণাধারায় সন্তাপভরা হৃদয়কে সিক্ত করতে। আর আমি সরে যাব আরও পশ্চিম গোলার্ধে। হয়তো জীবনে আর কখনও দেখা হবে না আমাদের। হয়তো সময়ের অমোঘ আবর্তনে ক্রমেই চাপা পড়ে যাবে এই স্বল্প সাক্ষাতের আন্তরিক গল্পগাথা। এগিয়ে চলবে জীবন। তার অমোঘ হাতছানিতে এগিয়ে যাব আমরাও। আলো ক্রমে ফুরিয়ে আসে। ডুবে যাওয়ার অধীর অপেক্ষায় হেলে পড়া সূর্যের টকটকে ঠোঁটে রবি ঠাকুরও বুঝি মুচকি হাসলেন, ‘হায় রে হৃদয়/ যা কিছু সঞ্চয়/ দিনান্তে নিশান্তে পথপ্রান্তে সবই ফেলে যেতে হয়।’
অধ্যাপক, বেলডাঙা এসআরএফ কলেজ