রাজ্য জুড়ে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’-এর প্রচার চালালেও পথ দুর্ঘটনায় তেমন রাশ টানা যায়নি বলে মনে করছে প্রশাসন। তাই এ বার বেপরোয়া ও মত্ত চালকদের শায়েস্তা করতে তাঁদের লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা পুলিশের হাতে তুলে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এত দিন শুধুমাত্র বাণিজ্যিক লাইসেন্স বাতিল করতে পারত পুলিশ। এ বার থেকে যে কোনও লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হল তাদের। মঙ্গলবার রাজ্য পরিবহণ দফতর থেকে এই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পরিবহণ দফতর।
গত অগস্ট মাস থেকেই নিরাপদে গাড়ি চালিয়ে জীবন রক্ষা করার আবেদন জানিয়ে প্রচার চালাচ্ছে সরকার। কিন্তু এই চার মাসে রাস্তায় মত্ত ও বেপরোয়া চালকদের কোনও হেলদোল তো দেখা যায়ইনি, বরং হাজরা মোড়ে পথ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবাসনে ঢুকে গাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটেছে। মত্ত চালকের হাতে পুলিশের মার খাওয়ার ঘটনাও দেখা গিয়েছে।
সম্প্রতি রাজ্যে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে রাজ্যের পদস্থ পুলিশকর্তা এবং পরিবহণ দফতরের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানেই পুলিশের তরফে সব রকম লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা তাদের হাতে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। বলা হয়, এতে চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা অনেকটাই কমানো যাবে। বিশেষত, রাতে অনেক সময়েই বাণিজ্যিক লাইসেন্স নয়, এমন অনেক চালক বেপরোয়া ভাবে বা মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালান। তাঁদের বিরুদ্ধে তেমন কোনও কড়া ব্যবস্থা নিতে পারে না পুলিশ। বেপরোয়া এই চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা মোটর ভেহিক্লস ইনস্পেক্টরদের। কিন্তু পরিবহণ দফতরের হাতে এক দিকে পর্যাপ্ত সংখ্যায় ইনস্পেক্টর নেই, নেই যথেষ্ট পরিকাঠামোও। এর পরেই পুলিশের প্রস্তাবে সম্মতি দেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘সরকার মনে করে, রোগ সারানোর থেকে রোগ প্রতিরোধই বেশি প্রয়োজন। তাই বেপরোয়া গাড়ি চালানোর উপরে লাগাম টানার বিষয়ে কড়া হতে চাইছে সরকার।’’ এতে দুর্ঘটনা আখেরে কমবে বলেই মনে করছেন রাজ্য পুলিশ ও পরিবহণ দফতরের পদস্থ কর্তারা। পুলিশের এক কর্তা জানান, পথে যত বাইক চলে, তার সিংহভাগের ব্যক্তিগত লাইসেন্স। ইদানীং সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে। বাইক দুর্ঘটনাও হচ্ছে বেশি। এত দিন এদের লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা ছিল না পুলিশের। এ বার সেই অধিকার মেলায় সুবিধা হল।
কী কী ক্ষেত্রে লাইসেন্স বাতিল হতে পারে? পরিবহণ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, চূড়ান্ত মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে ধরা পড়লে লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। বাতিল হতে পারে অত্যধিক দ্রুত গতিতে গাড়ি চালালেও। এ ছাড়া, উপর্যুপরি ট্র্যাফিক আইন ভাঙা এবং বেপরোয়া চালানোর কারণেও কোনও চালকের লাইসেন্স বাতিল করতে পারবে পুলিশ।
রাজ্য পরিবহণ দফতর জানাচ্ছে, কেন্দ্রীয় মোটর ভেহিক্লস আইনে কোন কোন ক্ষেত্রে চালকের লাইসেন্স বাতিল করা যাবে, তার নির্দিষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া আছে। কিন্তু কাদের হাতে ওই লাইসেন্স বাতিলের অধিকার থাকবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই। এটা সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের উপরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ রাজ্যে এত দিন পর্যন্ত ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল মোটর ভেহিক্ল রুল’-এর ৩ নম্বর ধারায় বাণিজ্যিক লাইসেন্স বাতিলের অধিকার দেওয়া ছিল পুলিশের হাতে। বাকি সব ক্ষেত্রে ওই ক্ষমতা দেওয়া ছিল মোটর ভেহিক্লস ইনস্পেক্টরদের হাতে। রাজ্য পরিবহণের এক কর্তা বলেন, ‘‘মঙ্গলবার ওই সংক্রান্ত বিধিটি সংশোধন করে পুলিশের হাতে যাবতীয় লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।’’
নতুন নির্দেশিকা জারি হলেও ঘটনাস্থলে বা যে কোনও পুলিশ অফিসারই অভিযুক্ত চালকের লাইসেন্স বাতিল করতে পারবেন না। বলা হয়েছে, অভিযোগের গুরুত্ব বুঝে ওই চালকের লাইসেন্স বাতিলের আবেদন করবেন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার। কমিশনারেটের ক্ষেত্রে ওই অভিযোগের শুনানি করবেন সংশ্লিষ্ট ডেপুটি কমিশনার (ট্র্যাফিক)। জেলার ক্ষেত্রে শুনানি করবেন সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার। শুনানির পরে তাঁরাই অভিযুক্ত চালকের লাইসেন্স বাতিল করতে পারবেন। তবে নতুন ব্যবস্থায় পুলিশের গা জোয়ারি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন পরিবহণ দফতরের একাংশের কর্তারা। দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘কার লাইসেন্স বাতিল হতে পারে তা অনেকটাই নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট সার্জেন্টের মতামতের উপরে। এখানেই দুর্নীতির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।’’ তবে এসপি বা ডিসি (ট্র্যাফিক) লাইসেন্স বাতিল করলেও অভিযুক্ত চালকের হাতে ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জের সুযোগ থাকবে। আইন মতে সংশ্লিষ্ট চালক মনে করলে সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন।