কৃষি বিপণন সংস্কার আপাতত ঠান্ডা ঘরে

মন্ত্রিসভা যখন অনুমোদন করে, তখন আপত্তি ছিল না। কিন্তু বিধানসভায় পেশ হতেই পাল্টে গেল মতটা। শাসক দলের কয়েক জন মন্ত্রীর আপত্তির জেরে বৃহস্পতিবার কৃষি বিপণন সংস্কার সংক্রান্ত বিল পাঠিয়ে দেওয়া হল সিলেক্ট কমিটিতে। সরকারের তরফে বিলটি নিয়ে বিশদে আলোচনার কথা বলা হলেও প্রশাসনিক মহলের একটি বড় অংশের মতে, বেসরকারি লগ্নি নিয়ে ছুঁৎমার্গের জেরেই আপাতত সেটি ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১১
Share:

মন্ত্রিসভা যখন অনুমোদন করে, তখন আপত্তি ছিল না। কিন্তু বিধানসভায় পেশ হতেই পাল্টে গেল মতটা। শাসক দলের কয়েক জন মন্ত্রীর আপত্তির জেরে বৃহস্পতিবার কৃষি বিপণন সংস্কার সংক্রান্ত বিল পাঠিয়ে দেওয়া হল সিলেক্ট কমিটিতে। সরকারের তরফে বিলটি নিয়ে বিশদে আলোচনার কথা বলা হলেও প্রশাসনিক মহলের একটি বড় অংশের মতে, বেসরকারি লগ্নি নিয়ে ছুঁৎমার্গের জেরেই আপাতত সেটি ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হল।

Advertisement

কৃষিপণ্য বিপণনে বেসরকারি লগ্নি টানতে এ দিন বিধানসভায় পশ্চিমবঙ্গ কৃষিপণ্য বিপণন (নিয়ন্ত্রণ) সংশোধনী আইন পাশ করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য সরকার। যে আইনের মূল কথা, জেলায় জেলায় বেসরকারি উদ্যোগে কৃষি বাজার গড়ে তোলা হবে। সেখানে চাষিদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কেনা এবং তার বিপণনে সরকারের কোনও ভূমিকা থাকবে না। বাজার তৈরির জমি কোথা থেকে পাওয়া যাবে, রাজ্যের সামগ্রিক ভাবমূর্তির পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি সংস্থাগুলি লগ্নি করতে রাজি হবে কি না, এই সব প্রশ্ন থাকলেও কৃষি সংস্কারের লক্ষ্যে এই আইন যে একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হতে চলেছিল, সে ব্যাপারে প্রশাসনিক কর্তাদের মধ্যে দ্বিমত নেই। কেন্দ্রের তরফ থেকেও দীর্ঘদিন ধরেই এই সংস্কার করার জন্য রাজ্যের উপরে চাপ দেওয়া হচ্ছিল।

বুধবার বিধায়কদের মধ্যে প্রস্তাবিত বিলটি বিলি করার পরে বৃহস্পতিবার সকালে সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় বিধানসভায়। আলোচনা শেষে বিল পাশ করানোর উদ্দেশে জবাবি বক্তৃতাও দিতে শুরু করেন কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়। এই সময় আইন প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য উঠে এসে তাঁর পিঠে টোকা মেরে কিছু একটা বলেন। তার পরেই উঠে দাঁড়ান পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “সভার প্রায় সব সদস্যই চাইছেন, বিলটি সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হোক। সরকার সেই দাবি মেনে নিচ্ছে।”

Advertisement

পরে পার্থবাবু বলেন, “বিধায়কেরা মাত্র এক দিনের মধ্যে বিলটি ভাল ভাবে পড়ার সুযোগ পাননি। তাই সেটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়ে কিছু দিন সময় নেওয়া হল।” তিনি জানান, সিলেক্ট কমিটি ১৫ দিনের মধ্যে আলোচনা করে তাদের মতামত জানাবে। তার পর প্রয়োজনে অর্ডিন্যান্স করেও এই আইন জারি করা হতে পারে। শাসক দলের একটি অংশও দাবি করছে, চলতি বিধানসভাতেই তাড়াহুড়ো করে একাধিক বিল পাশ করতে গিয়ে সরকারের মুখ পুড়েছে। উপাচার্য বাছাইয়ের যাবতীয় ক্ষমতা সরকারের হাতে নিতে চেয়ে যে বিল আনার চেষ্টা হয়েছিল, তীব্র বিতর্কের মুখে শেষ মুহূর্তে তা আটকে দেওয়া হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন ভাবে ১৬টি সংশোধনী আনা হয়। ফলে কৃষি সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিল নিয়ে ধীরে চলার পক্ষেই রায় দেন একাধিক মন্ত্রী।

কিন্তু প্রশ্ন হল, সংশ্লিষ্ট দফতর, মন্ত্রিসভার বৈঠক এবং আইন বিভাগ ঘুরে আসার পরেও বিল নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার দরকার হচ্ছে কেন? প্রশাসনিক কর্তাদের একটি অংশের অভিযোগ, মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের সময় কেউই বিলটি ভাল ভাবে পড়ে দেখেননি। এ দিন সংবাদমাধ্যমে বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হওয়ার পরেই নড়েচড়ে বসেন শাসক দলের নেতারা।

অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, খুচরো বাজারে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের প্রশ্নেই কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল তৃণমূল। এখন কার্যত সেই পথ প্রশস্ত করার বিল আনা হচ্ছে কী ভাবে! একাধিক তৃণমূল বিধায়ক বলেন, তাঁদের দল বরাবরই কৃষিতে একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজির জন্য দরজা খোলার বিরোধিতা করে এসেছে। কিন্তু কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় যে বিনিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব নতুন বিলে করা হয়েছে, তাতে কৃষি বাজার বেসরকারি হাতেই চলে যাবে।

মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সকালে শহরের বাইরে ছিলেন। তিনি এই বিল সম্পর্কে সম্যক অবহিত কি না, সেই প্রশ্নও ওঠে। যদিও প্রশাসনিক সূত্রে বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি জানানোর দায়িত্ব মুখ্যসচিবের। তা ছাড়া, বিলটি যখন মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে, তখন মুখ্যমন্ত্রী জানেন না, তা বলা যাবে না। এ বিষয়ে মুখ্যসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।

তৃণমূল নেতারা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে বিলটি নিয়ে এগোনোর ঝুঁকি নেননি। দলীয় সূত্রের খবর, এ দিন অধিবেশন শুরু হতেই পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং পরিষদীয় সচিব তাপস রায় অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে বিলটি পেশ করা পিছিয়ে দেওয়া যায় কি না তা নিয়ে আলোচনা করেন। অধ্যক্ষ তাঁদের জানান, এখন আর তা সম্ভব নয়। তখন পার্থবাবুকে অধ্যক্ষের ঘরে ডেকে নিয়ে আলোচনা হয়। ঠিক হয়, বিলটি সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হবে। তত ক্ষণে অবশ্য বিধানসভা কক্ষে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে।

জলপাইগুড়ি কেন্দ্রের কংগ্রেস বিধায়ক সুখবিলাস বর্মা সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, “আমি এঁদের (বাম বিধায়কদের দেখিয়ে) আমলে কৃষিসচিব থাকার সময় অনেক অনুরোধ করেছিলাম এই আইনকে সাজিয়ে তোলার জন্য। কিন্তু ওঁরা কিছুই করেননি। করলে সরকার প্রচুর উপার্জন করতে পারত। কৃষকদেরও প্রভূত উপকার হবে।”

অন্য দিকে সিপিএমের শাজাহান চৌধুরী, গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায় থেকে এসইউসি-র তরুণ নস্কররা দাবি জানান, সিলেক্ট কমিটিতে বিলটি নিয়ে চুলচেরা বিচার-বিবেচনা হোক। শাজাহান চৌধুরীর মতে, এই সরকার আলু নিয়ে যে পদক্ষেপ করেছে, তাতে উপকার হয়নি। বরং প্রাদেশিকতা মাথাচাড়া দিয়েছে। ফড়ে-দালালদের কবলে পড়ে মার খেয়েছেন কৃষকেরা।

এসইউসি-র তরুণবাবু বলেন, “বৃহৎ পুঁজি বাজার ধরাতে লোভনীয় সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করবে। ফলে নিয়ন্ত্রিত বাজার শুকিয়ে যাবে। মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু এখন সেই সুবিধাই করে দেওয়া হচ্ছে এই বিলে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement