প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোনারপুরের একটি অডিটোরিয়ামে। বৃহস্পতিবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।
জুলুম, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট নিয়ে এত দিন তিনি নিজের দলের নেতা-কর্মীকে হুঁশিয়ার করেছেন। গ্রেফতার করিয়েছেন কাউন্সিলরকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার সতর্ক করলেন নিজের আমলাদের।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রশাসনিক বৈঠক ছিল বৃহস্পতিবার। ওই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, সরকারি আধিকারিক ও ঠিকাদারদের গোপন আঁতাঁত কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। আঁতাঁতের প্রমাণ পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে উভয়ের বিরুদ্ধে। ঠিকাদার ঠিক মতো কাজ না করলে বা কাজের মান খারাপ হলে, তাঁকে কালো তালিকাভুক্ত করতেও দ্বিধা করবে না সরকার।
মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন কঠোর বার্তা এ দিন আচমকা আসেনি। সোনারপুরের মহামায়াতলার একটি সভাগৃহে এ দিনের বৈঠক শুরু হওয়ার পর জেলার একাধিক বিধায়ক ও জনপ্রতিনিধি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ঠিকাদার সংস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি ও দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে নানা অভিযোগ করেন। জেলায় জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের অধীনে ৩৭টি জলের প্রকল্পের কাজ চলছে। তার সব ক’টিতেই কমবেশি গড়িমসির অভিযোগ তোলেন স্থানীয় বিধায়ক ও জনপ্রতিনিধিরা। তাতে সংযোজন করেন বারুইপুর (পশ্চিম)-এর বিধায়ক তথা বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘জলের পাইপলাইন অনেক জায়গায় বসেছে ঠিকই। কিন্তু জল কই!’’
আবার রায়দিঘির বিধায়ক দেবশ্রী রায় বলেন, ‘‘একটি নবনির্মিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীরা বহির্বিভাগে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারেন না। কারণ এমন ভাবে স্বাস্থ্যভবনটি তৈরি হয়েছে যে, সব সময় জল দাঁড়িয়ে রয়েছে।’’ এ কথা শুনেই চটে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী! বলেন, ‘‘রোগীও জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবে! বাহ্ খুব ভাল তো!’’ তার পরই ধমকের সুরে জানিয়ে দেন, ‘‘দলীয় স্তরে তোলাবাজি বন্ধ করতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তা হলে সরকারি অফিসার যদি কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা ঠিকাদারের সঙ্গে আঁতাঁত করে চলার চেষ্টা করেন, তিনি নিস্তার পাবেন কেন? ওঁদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার।’’ এর পরেই জেলাশাসক পি ভি সেলিমের দিকে তাকিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘যে ঠিকাদাররা ঠিকমতো কাজ করবে না, তাঁদের কালো তালিকাভুক্ত করে বাতিল করুন।’’
প্রসঙ্গত জেলাশাসক সেলিমের বিরুদ্ধেই সম্প্রতি আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। সে বিষয়ে সরকার এখনও প্রশাসনিক তদন্ত শুরু করেনি ঠিকই। কিন্তু এ দিনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী তাৎপর্যপূর্ণ ভাবেই সেলিমকে বলেন, ‘‘অডিট রিপোর্ট নিয়মিত পরীক্ষা করুন। পরবর্তী জেলাশাসক যেন বিপদে না পড়েন।’’
জেলায় পানীয় জল ও সড়ক নির্মাণের কাজে গতি না আসার ব্যাপারেও এ দিনের বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। পানীয় জল সরবরাহের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের সচিব সৌরভ দাসকে ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। বৈঠকে বাসন্তী হাইওয়ের বেহাল অবস্থার কথা তুলেছিলেন কলকাতার মেয়র তথা আবাসন মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়। সেই প্রসঙ্গে পূর্তসচিব ইন্দিবর পাণ্ডের কাছে বাসন্তী হাইওয়ে এবং ডায়মন্ড হারবার-জোকা রাস্তার অবস্থা নিয়ে খোঁজ নেন মুখ্যমন্ত্রী। দু’টি সড়কই সরেজমিন খতিয়ে দেখে তাঁকে রিপোর্ট দিতে বলেন।
বৈঠকে সাতগাছিয়ার বিধায়ক সোনালি গুহ ডায়মন্ড হারবার এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে পরিকাঠামোর অভাব এবং সে জন্য টাকাকড়ির সমস্যার কথা তুলেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তখন প্রস্তাব দেন, সাংসদ তহবিলের টাকা দিয়ে এ কাজ হতে পারে। ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ, মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। তিনিও উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, সাংসদ তহবিলের টাকায় যাতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির হাল ফেরে, তা তিনি অবশ্যই দেখবেন।
বৈঠকে জলাভূমি ভরাটের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন ক্রীড়া ও পূর্ত দফতরের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। তিনি জানান, সোনারপুর থানা এলাকার খেয়াদহ ১ ও ২ এলাকায় বহু জলাজমি ভরাট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আসছে। তা শুনে মুখ্যমন্ত্রী ফের স্পষ্ট করে দেন, জলাজমি বেআইনি ভাবে ভরা়ট করা চলবে না। তার চেষ্টা হলে পুরসভা ও পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়াও জলপথ-পরিবহণ নিয়ে তিনি জানান, ‘‘জেলায় বহু মানুষ ভুটভুটিতে যাতায়াত করেন। তাঁদের সুবিধার জন্য আপাতত ১০টি ভেসেল কেনা হচ্ছে। ভুটভুটির উপর নজর রাখতে বলছি।’’
এ দিনের বৈঠকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা ভাগের ব্যাপারেও আলোচনা হওয়ার একটা প্রস্তাব ছিল। সরকারি সূত্রেই বলা হচ্ছিল, জেলা ভেঙে সুন্দরবন নামে একটি নতুন জেলা তৈরি করা হবে। বৈঠকের পর সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘ওই প্রস্তাব নিয়ে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন। মাস তিনেক পরে বিষয়টি নিয়ে এগোনো হবে।’’
এ দিনই মুখ্যমন্ত্রী সবুজশ্রী, সমব্যথী ও বৈতরণী নামে তিনটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এ বছর ২৭ মে-র পর থেকে যে শিশুরা জন্মেছে এবং জন্মাবে, তাদের পরিজনকে একটি করে মেহগনি গাছ বিতরণ করা হবে। দুঃস্থ ব্যক্তিরা প্রিয়জনের শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য রাজ্য সরকারের কাছ থেকে ২০০০ টাকা অনুদান পাবেন সমব্যথী প্রকল্পে। তা ছাড়া জেলায় সব শ্মশানঘাট পাঁচিল দিয়ে ঘেরার জন্যও আর্থিক সাহায্য করবে রাজ্য। সোনারপুর (উত্তর) বিধানসভায় শ্মশানের পাঁচিল ঘেরা বাবদ ১০ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর।