এই সেই হোটেল। —নিজস্ব চিত্র।
শিলিগুড়ির ‘লাইফ-লাইন’ হিসেবে পরিচিত হিলকার্ট রোডের এক রেস্তোরাঁ থেকে সাত খুদে শ্রমিককে উদ্ধারের দু’সপ্তাহ পরেও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পুলিশ ও শ্রম দফতর ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই সঙ্গে কিশোর-শ্রমিকদের উদ্ধারের পরে কোথায় রাখা হয়েছে তা নিয়ে পুলিশের তরফে আদালতে ভুল তথ্য জানানোর অভিযোগও উঠেছে। পুলিশের দেওয়া সেই তথ্যের ভিত্তিতেই আদালতের পক্ষ থেকে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিকে সশরীরে তলব করাও হয়েছে। কিন্তু, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে ওই কিশোর শ্রমিকরা অন্যত্র রয়েছে বলে জানানোর পরে আদালত ফের নতুন নির্দেশ দিয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, ওই মামলায় আট দিনের মধ্যে চার দফায় শুনানি হয়েছে। কিন্তু, দার্জিলিং জেলার চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া কিশোরদের জবানবন্দি, তাদের মানসিক অবস্থা, তারা কী চাইছে সে সব সংগ্রহ করে আদালতে পুলিশ কেন দাখিল করেনি তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এমনকী, রেস্তোরাঁ মালিকের বিরুদ্ধে শিশুশ্রম আইনের ধারা প্রয়োগ কিংবা জরিমানা ধার্য করার প্রক্রিয়াও কেন এগোচ্ছে না সেই প্রশ্নও তুলেছেন একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা।
এমন নানা অভিযোগের খবর পৌঁছেছে পুলিশের উপর মহলেও। শিলিগুড়ি থানার যে অফিসার আদালতে ভুল রিপোর্ট দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ, তাঁর ভূমিকা খতিয়ে দেখতে বিভাগীয় তদন্তের দাবিও উঠেছে। শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি (সদর) অংমু গ্যামসো লেপচা বলেন, “ওই কিশোরদের উদ্ধারে তো পুলিশই সহযোগিতা করেছে। তবুও পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠবে কেন? এটা কাম্য নয়। আমরা সব কিছু খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করব।” শ্রম দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা মহম্মদ রিজওয়ান এই প্রসঙ্গে বলেন, “ওই হোটেল মালিকের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে জরিমানা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” কিন্তু, হোটেল মালিক বাসুদেব প্রসাদের ছেলে রবিপ্রসাদ বলেন, “অনেক হোটেলেই তো এমন হয়। যাই হোক, আমরা অন্যায় করেছি। আমাদের জরিমানা হলে মাথা পেতে নেব। তবে এখনও কোনও নোটিশ পাইনি।’’
ঘটনার সূত্রপাত ১৩ মে। সে দিন হিলকার্ট রোডের ‘গুপ্তা স্ন্যাকস অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’-এ খেতে গিয়ে জনৈক খদ্দেরের নজরে পড়ে খুদে শ্রমিকদের। তাদের বিবর্ণ চেহারা, ম্লান মুখ দেখে টুকটাক কথাবার্তা বলেন তিনি। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি ‘চাইল্ডলাইন’-এর টোল ফ্রি নম্বরে ফোন করে গোটা বিষয়টি জানিয়ে ওই শ্রমিকদের উদ্ধারের অনুরোধ করেন। চাইল্ডলাইনের দার্জিলিং জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী সোনুবাহাদুর ছেত্রী বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সোনু শিলিগুড়ির এডিসিপি-র কাছে গিয়ে সব জানান। এডিসিপির নির্দেশে পুলিশের ডিডেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অফিসার-কর্মীরা সোনুকে সঙ্গে নিয়ে ওই হোটেলে যান। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় ৭ নাবালককে। তাদের শিলিগুড়ি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
পুলিশ জানায়, উদ্ধার হওয়া নাবালকদের নাম আবদুল রজ্জাক, রিয়াজুল হোসেন, মকসেদ আলম, মেহবুব আলম, নাসির আলমস মকসুদ আলম, মুজফ্ফর আলম। ৫ জনের বয়স ১৪ বছরের নিচে। ২ জনের ১৪ বছরের বেশি কিন্তু ১৮ বছরের কম। সকলেরই বাড়ি ইসলামপুরের গুয়াবাড়ি এলাকায়। প্রাথমিক তদন্তে ওই কিশোররা জানায়, তাদের সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করানো হতো। হোটেলের যাবতীয় কাজকর্ম, মালিকের বাড়ির ফাইফরমাস খাটার বিনিময়ে গড়পরতায় ২২০০ টাকা করে মাসে পেত তারা। কিন্তু, ওই কিশোররা হাতে পেত মাত্র ২০০ টাকা। বাকি টাকা তাদের বাড়ির লোকদের কাছে পাঠানো হতো বলে তারা পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে জানিয়েছে। প্রাথমিক জেরার পরে পুলিশ চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির মাধ্যমে প্রথমে ‘সিনি’ নামে একটি সংস্থার অপিসে তাদের নিয়ে যায়। সেখানকার হোমে শুধু নাবালিকাদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তাই এনজেপি এলাকায় ‘কনসার্ন’ হোমে কিশোরদের পাঠানো হয়।
এর পরে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সূত্রের খবর, চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সদস্যা বাসন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হিলকার্ট রোডের কয়েকজন ব্যবসায়ী গিয়ে বিষয়টি আইন-আদালতের বাইরে মিটিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু, তিনি তাতে বিরক্তি প্রকাশ করলে ওই ব্যবসায়ীরা নানাভাবে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ। ইতিমধ্যে এক ব্যক্তি একটি রাজনৈতিক দলের যুব নেতা পরিচয় দিয়ে কমিটিকে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার পরামর্শও দেন বলে অভিযোগ।
তখনই উদ্ধার হওয়া কিশোরদের একাংশ জানিয়ে দেয়, তারা হোমে থেকে পড়াশোনা করতে চায়। হাড়ভাঙা খাটুনির অন্ধকার জীবন থেকে তারা মুক্তি চায় বলে সিডব্লুসিকে জানিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে নাবালকদের অভিভাবকরা আদালতে হলফনামা নিয়ে আগামী দিনে ছেলেদের পড়াশোনা করাবেন ও ভালভাবে বাড়িতে রাখবেন বলে জানিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চান। আদালত সূত্রের খবর, তখনই পুলিশের কাছে আদালত কিশোররা কোথায় রয়েছে তা জানতে চায়। সেই সময়ে আদালতে পুলিশ জানায়, ওই কিশোররা ‘সিনি’ নামক সংস্থার হোমে রয়েছে। ২২ মে শিলিগুড়ির এসিজেএম ওই কিশোরদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ পালন না-করায় ‘সিনি’র প্রতিনিধিকে সশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। ২৭ মে সিনির প্রতিনিধি আদালতে হাজির হয়ে জানিয়ে দেন, উদ্ধার হওয়া নাবালকরা ‘কনসার্ন’-এ রয়েছে। তখন আদালত সেই সংস্থার হোমের সুপারকে কিশোরদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু, পুলিশ সেই নির্দেশ নিয়ে গেলেও ‘কনসার্ন’ জানিয়ে দেয়, হোমে সুপারের পদ নেই। ফলে, নির্দেশ নেওয়া সম্ভব নয়।
এর পরে অন্য জটিলতাও তৈরি হয়েছে। শিলিগুড়ি আদালতের একাধিক আইনজীবী জানান, জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট অনুযায়ী কোথাও নিরপরাধ নাবালক-নাবালিকা উদ্ধার হলে তাদের বাড়ি ফেরানো হবে কি না, কোথায়, কার হাতে ফেরানো হবে সেই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে সিডব্লুসি। যা কি না একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা। সে ক্ষেত্রে ওই কমিটির অনুমতি ছাড়া ‘কনসার্ন’ কিশোরদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দিতে পারে কি না সেই প্রশ্ন ওঠে। পক্ষান্তরে, আদালতের নির্দেশ অমান্য করলেও অবমাননার দায় বর্তাবে।
এই অবস্থায়, বিষয়টি নিয়ে হইচই হতে জেলা আদালত ও উচ্চ আদালতের আইনজীবী মহলেও আলোচনা শুরু হয়। বৃহস্পতিবার ফের শিলিগুনির এসিজেএম-এর আদালত কক্ষে মামলার শুনানি হয়। সেখানে সরকারি তরফে সুদীপ রায় বসুনীয়া বিষয়টি তুলে ধরেন। নাবালকদের অভিভাবকদের তরফে আইনজীবী ইউসুফ আলি এ দিন অভিযোগ করেন, আদালতের নির্দেশ অমান্য করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ইউসুফ বলেন, “প্রথমে পুলিশ ভুল রিপোর্ট দেওয়ায় জটিলতার সূত্রপাত হয়েছে। এখন আমরা সুবিচারের আশায় রয়েছি।”