সমস্যা থাকলেও সম্ভাবনা অনেক

সে ছিল এক অন্য শিলিগুড়ি। সন্ধ্যে নামলেই নদীর ধারে শেয়ালের হাঁক। রাত আরেকটু নিঝুম হলে বসতি এলাকায় শুধুই ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। সব কিছুকে ছাপিয়ে মাঝরাতে সাইরেন বাজিয়ে ছুটে যেত দিল্লি মেল। দু-দশক আগেও এনজেপি স্টেশন ও লাগোয়া এলাকার চেহারাটা এমনই ছিল। অদূরে ইন্ডিয়ান অয়েলের ডিপো। গা ঘেঁষে ফুড কর্পোরেশনের বিশাল গুদাম।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৪ ০১:৫১
Share:

দ্রুত বদলে যাচ্ছে পুরনো শিলিগুড়ি। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

সে ছিল এক অন্য শিলিগুড়ি। সন্ধ্যে নামলেই নদীর ধারে শেয়ালের হাঁক। রাত আরেকটু নিঝুম হলে বসতি এলাকায় শুধুই ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। সব কিছুকে ছাপিয়ে মাঝরাতে সাইরেন বাজিয়ে ছুটে যেত দিল্লি মেল। দু-দশক আগেও এনজেপি স্টেশন ও লাগোয়া এলাকার চেহারাটা এমনই ছিল। অদূরে ইন্ডিয়ান অয়েলের ডিপো। গা ঘেঁষে ফুড কর্পোরেশনের বিশাল গুদাম। চোরাই তেলের কারবার, ওয়াগান ভেঙে খাদ্যশস্য, কয়লা পাচার চক্র তখন সবে হাত পাকাচ্ছে। রাতের এনজেপি মানেই ছিল নানা ভয়, আতঙ্ক। কিছুটা বাস্তবসম্মত। কিছুটা অমূলক।

Advertisement

১৯৯২ সালে সেই এনজেপি-তে রেলের স্লিপার তৈরির কারখানা খুলেছিলেন শিলিগুড়ির এক শিল্পোদ্যোগী কমল মিত্তল। বিস্তর ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট, চাঁদা তোলার জুলুম সামলে দাঁতে দাঁত চিপে কারখানা চালিয়েছেন। ধীরে ধীরে ব্যবসা বেড়েছে। দেশের নানা প্রান্তে তো বটেই, বিদেশেও সংস্থা পৌঁছেছে। সৌদি আরবেও এখন কারখানা গড়ে ব্যবসা করছে পিসিএম গ্রুপ নামের সংস্থাটি। ২০১৩ সালে জার্মানির ‘রেল ওয়ান’ নামে প্রথম সারি রেল পরিকাঠামো নির্মাণ সংস্থাকে অধিগ্রহণ করেছে পিসিএম গ্রুপ। এনজেপিতে সেই স্লিপার কারখানা এখন ভালই চলছে। সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে শিলিগুড়ির এক উদ্যোগীর ‘জার্মান-বিজয়’-এর কাহিনী এখন এলাকাবাসীর মুখে মুখে ফিরছে। কমলবাবুর কথায়, “শিলিগুড়ির অনেক সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু দ্বিগুণ সম্ভাবনাও রয়েছে। সেটা কাজে লাগানোর জন্য জেদ, অধ্যবসায় দরকার। তা থাকলে কোনও কিছুই বাধা হতে পারবে না।”

বস্তুত, শিলিগুড়ির বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি হচ্ছে বলেই শহরে জনবসতির চাপ বাড়ছে। তা বলে সরকারি উদ্যোগে কোনও বড় মাপের শিল্প গড়ে উঠেছে তেমন নয়। বড় মাপের কোনও বিনিয়োগ এসেছে বাইরে থেকে তেমনও ঘটেনি। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে ‘ট্রেড সেন্টার’ হিসেবে ক্রমশই জমজমাট হয়েছে শিলিগুড়ি। দেশ-বিদেশের নামী সংস্থার কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় বিক্রয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে শিলিগুড়ি। শুধু শহরাঞ্চল ও লাগোয়া এলাকার জনসংখ্যা এখন ৫ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের মতো বড় কারখানা না থাকায় কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ তৈরি হয়নি সিলিগুড়িতে। তাতে হাত গুটিয়ে অবশ্য বসে থাকছেন না স্থানীয় বেকার যুবক-যুবতীরা। অন্তত শহর লাগোয়া এলাকায় ছোট ও মাঝারি মাপের কারখানা গড়ার প্রবণতা সে কথাই বলছে।

Advertisement

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ইদানীং শহর লাগোয়া ইস্টার্ন বাইপাস এলাকায় তৈরি হয়েছে অন্তত দেড়শোটি ছোটবড় কারখানা। এলাকার উদ্যমী যুবক-যুবতীরা মূলত নিজেদের চেষ্টায় কেউ গড়ে তুলেছেন জ্যাম, জেলির কারখানা। আবার কেউ ধূপকাঠি তৈরি করাচ্ছেন। কেউ রট আয়রনের আসবাব তৈরি করে উত্তর পূর্ব ভারতের বাজারে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। রাজ্য বিদ্যুত্‌ বণ্টন নিগমের তথ্য অনুযায়ী, শিলিগুড়ির ইস্টার্ন বাইপাসেই বাণিজ্যিক বিদ্যুত্‌ সংযোগের সংখ্যা এক দশকে দ্বিগুণ বেড়েছে। ফুলবাড়ি এলাকাতেও ছোট ও মাঝারি মাপের কারখানা গড়তে আগ্রহীর সংখ্যা বাড়ছে। যেমন দেড় দশক আগেও সামান্য মাইনেয় একটি নার্সিংহোমে ম্যানেজারের কাজ করতেন সঞ্জিত সাহা। একটা সময়ে নিজে ব্যবসা করবেন ভেবে চাকরি ছেড়ে দেন। ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে কয়েকজন অংশীদারকে নিয়ে গড়ে তোলেন একটি রট আয়রনের আসবাব তৈরির কারখানা। এখন সঞ্জিতবাবুর কারখানায় চাকরি করেন ১২৫ জন। পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যবসায় করছে সংস্থাটি।

এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে অনেক। সে কথার উল্লেখ করে কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজের উত্তরবঙ্গ শাখার চেয়ারম্যান প্রবীর শীলের কথায়, “শিলিগুড়িতে বড় কারখানা নেই সে কথা ঠিক। একটা সময়ে মূলত চায়ের উপরে নির্ভরশীল ছিল এলাকার অর্থনীতি। এখন উদ্যোগীদের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষিক বেকাররা শিলিগুড়িতে নানা ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। যা শহরের পক্ষে অন্তত আশার কথা।” সিআইআইয়ের পক্ষ থেকেও প্রবীরবাবুরা নিয়মিত স্থানীয় আগ্রহী তরুণ-তরুণীদের নানা ধরনের ছোট ও মাঝারি মাপের শিল্প স্থাপনের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। যে সব উদ্যোগীরা কারখানা গড়তে নেমে নানা সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের সঙ্গে সরাসরি পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমের শীর্ষ কর্তাদের মুখোমুখি বসিয়ে সমাধানের পথ খোলার চেষ্টাও করছে সিআইআই। ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, নর্থ বেঙ্গলের (ফোসিন) সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিত্‌ দাস মনে করেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পই শিলিগুড়িকে ঘুরে দাঁড় করাতে পারে। বিশ্বজিত্‌বাবু বলেন, “সরকারের পক্ষে তো সব কিছু করা সম্ভব নয়। সেটা বুঝতে হবে। শিলিগুড়ি হল ব্যবসার জায়গা। সেটা অভিভাবকদেরও মাথায় রাখতে হবে। শুধু চাকরির জন্য হা-হুতাশ না করে উদ্যমী হতে হবে। যাঁরা মাঠে নেমে ঘাম ঝরাচ্ছে, তাঁরা ফল পাচ্ছেন। আমরা সব রকম সাহায্য করছি।”

সিআইআই, ফোসিনের মতো সংস্থা আশার আলো দেখাচ্ছে। পক্ষান্তরে, সরকারি তরফের একাংশের কাজকর্ম, ভূমিকায় ক্ষোভ বাড়ছে শিলিগুড়িতে। কারণ, সরকারি তরফে শিল্প স্থাপন নিয়ে নিয়মিত সেমিনার হলেও বাস্তবে শিলিগুড়িতে বাইরের বিনিয়োগ হাতে গোনা। বাম আমলে চাঁদমণি চা বাগান উপড়ে উপনগরী পত্তনের সুবাদে বিনিয়োগ হয়েছিল প্রচুর টাকা। এর পরে বাইরের বিনিয়োগ সে ভাবে আসেনি। তৃণমূল জমানায় শহরের ডাম্পিং গ্রাউন্ডের জায়গায় বড় মাপের প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, বিনোদন পার্ক গড়ার প্রক্রিয়া গোড়াতেই হোঁচট খেয়েছে। এমনকী, শিলিগুড়ি পুর এলাকায় একটি বড় মাপের বেসরকারি হাসপাতাল তৈরির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার পরেও মামলার জটে তা থমকে গিয়েছে। পুরসভা সূত্রের খবর, ও ই হাসপাতাল হলে শিলিগুড়িতে অন্তত ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। বামেদের দখলে থাকা পুরবোর্ডকে সরিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট সাড়ে ৪ বছর আগে বোর্ড দখল করার পরে কেন বড় মাপের বিনিয়োগ আনতে ব্যর্থ হয়েছে, সে প্রশ্ন এখন সর্বত্রই।

শিলিগুড়ির বাসিন্দা তথা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান দেবব্রত মিত্র বলেন, “শিলিগুড়ির মতো শহর অবস্থানগত কারণেই আগামী দিনে আরও গুরুত্বপূর্ণ হবে। সেই সুবাদে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রও প্রসারিত হবে। সে জন্য নিজগুণেই বিনিয়োগ টানবে শিলিগুড়ি। কিন্তু সরকারকে পরিকাঠামো ঠিকঠাক রাখাটা নিশ্চিত করতে হবে। শহরটা যাতে সুন্দর, উপভোগ্য ও দূষণ মুক্ত হয়ে হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে হবে। না হলে শহরের সামগ্রিক সমৃদ্ধি কোনও দিন হবে না।” উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব এটা খোলাখুলি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “শিলিগুড়ি পুর এলাকায় অনেক কাজই মাঝপথে থমকে ছিল। ধীরে ধীরে তা চালু করানোর চেষ্টা হচ্ছে। যে সব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। বিনোদন পার্ক, হাসপাতাল তৈরির জট ছাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে।” সেই সঙ্গে উদ্যমী যুবক-যুবতীদের আরও বেশি করে ব্যবসায়িক প্রকল্পে সামিল করাতে সব দফতরকে নিয়ে একটি সুসংহত কর্মসূচি নেওয়ার কথা জানান তিনি।

সরকার কতটা কী করবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলবেই। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের উদ্যমীদের সৌজন্যে শিলিগুড়ির অর্থনীতি যে আরও জোরদার হবে, তা নিয়ে খুব একটা সংশয় ব্যবসায়িক মহলে নেই।

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement