উত্তরবঙ্গের আর পাঁচটা জায়গায় পায়ের তলায় মাটি আগেই মিলেছিল। কিন্তু জলপাইগুড়ি জেলার কোথাও কোনও ভাবেই যেন দাঁত ফোটাতে পারছিল না তৃণমূল। তা নিয়ে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোট থেকে ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন----প্রতিবারই ফল প্রকাশের পরে হতাশা দেখা গিয়েছে তৃণমূল শিবিরে। খোদ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বারেবারেই আক্ষেপ, উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অবশেষে ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের ফল হাসি ফোটাল তৃণমূল নেত্রীর মুখে। চা বলয়ের ‘লাল দুর্গ’ ধুলিসাৎ করে সেখানে ফুটল ঘাসফুল। জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার, দু’টি লোকসভা আসনই বামেদের থেকে ছিনিয়ে নিল তৃণমূল। চা বলয়ের অনেক এলাকায় দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে বিজেপি।
মালদহের দু’টি কেন্দ্র দখলে রাখতে পারলেও উত্তর দিনাজপুরে দুর্গ রক্ষা করতে ব্যর্থ কংগ্রেসও। কংগ্রেসের ঘাঁটি বলে পরিচিত রায়গঞ্জে দীপা দাশমুন্সিকে হারিয়ে ১৬৩৪ ভোটে জিতেছেন সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিম। ঘটনাচক্রে, রায়গঞ্জে বিজেপি প্রার্থী নিমু ভৌমিক পেয়েছেন ২ লক্ষেরও বেশি ভোট। সেখানে প্রার্থীদের কাউকে পছন্দ নয়, এমন (নোটা) ভোট পড়েছে ১০ হাজারের বেশি।
তবে সব থেকে কোণঠাসা অবস্থা বামেদের। তাঁদের কিছুটা মুখরক্ষা করেছে রায়গঞ্জ এবং কুমারগ্রাম। চা বলয়ের কুমারগ্রাম বিধানসভার উপনির্বাচনে আসনটি অল্প ব্যবধানে হলেও ধরে রাখতে পেরেছে বাম শরিক আরএসপি। সেখানে আড়াই হাজারের সামান্য বেশি ভোটে জিতেছেন আরএসপি প্রার্থী মনোজকুমার ওঁরাও। কিন্তু ঘাসফুল ও পদ্মফুলের প্রকোপে গোটা উত্তরবঙ্গেই দলের গ্রহণযোগ্যতা যে আগের চেয়েও শোচনীয় হয়েছে, সে কথা বাম শিবিরের প্রথম সারির নেতাদের অনেকেই একান্তে মানছেন। ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের বিরুদ্ধে লড়ে উত্তরবঙ্গের ৮ আসনের মধ্যে আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও বালুরঘাট বামেরা দখল করে। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটেও রাজ্য জোড়া ‘পরিবর্তনের হাওয়া’ সত্ত্বেও জলপাইগুড়িতে ১২টি আসনের মধ্যে ৫টি, কোচবিহারে ৯টির মধ্যে ৪টি বামেদের দখলে যায়। সে বার মালদহ, দুই দিনাজপুরের ৭টি বিধানসভা আসন তৃণমূল বিরোধী শিবিরের দখলে ছিল। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটেও জলপাইগুড়িতে ৩৭টি আসনের মধ্যে ২৭টি পেয়ে জেলা পরিষদ দখল করে বামেরা।
যে কারণে জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার আসনটি ধরে রাখার ব্যাপারে প্রবল আশাবাদী ছিল বাম শিবির। উত্তরবঙ্গের বাম শিবিরের প্রথম সারির নেতা প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য স্বীকার করেন, “জলপাইগুড়ির চা বলয়ে ভাল ফলের ধারাবাহিকতা থাকবে না, এটা ভাবাই যায়নি।” তাঁর কথায়, কেন এমন হল, কোথায় সুষ্ঠু ভোট হয়েছে, কোথায় হয়নি, কোথায় কী ত্রুটি রয়েছে, সব কিছু খোলা মনে বিশ্লেষণ করা হবে।
ঘটনা হল, লোকসভা ভোটের প্রচার পর্ব তুঙ্গে ওঠার পরে বালুরঘাট, কোচবিহারে জয়ের ব্যাপারে ঘোর আশাবাদী হয়ে ওঠে তৃণমূল শিবির। দার্জিলিং আসনে না-জিতলেও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা সমর্থিত বিজেপি প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান কমানোও একটা লক্ষ্য ছিল রাজ্যের শাসক দলের। সেই হিসেবটাও মিলেছে। দার্জিলিং আসনে গতবারের থেকে মোর্চা সমর্থিত বিজেপি প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান কমেছে প্রায় ৫৫ হাজার। তৃণমূলের অন্দরের আলোচনায় অনেক বিষয়ই উঠে এসেছে। প্রথমত, বিজেপি-র ভোট গত লোকসভা ভোটের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, এই দুই আসনে বিজেপি প্রার্থীরা পেয়েছেন যথাক্রমে ২ লক্ষ ২০ হাজারের বেশি এবং ৩ লক্ষ ৩৫ হাজারের বেশি ভোট। জলপাইগুড়িতে তৃণমূল প্রার্থী জিতেছেন প্রায় ৭০ হাজার ভোটে। আলিপুরদুয়ারে তৃণমূল জিতেছে প্রায় ২১ হাজার ভোটে।
দ্বিতীয়ত, তৃণমূল শিবির মনে করছে, লোকসভা ভোটের কয়েক মাস আগে জলপাইগুড়ি জেলার সংগঠনের দায়িত্ব প্রবীণদের হাত থেকে নিয়ে যুব নেতা সৌরভ চক্রবর্তীর হাতে তুলে দেওয়াতেও ভাল ফল মিলেছে। তিনি জলপাইগুড়ির দু’টি আসনের পর্যবেক্ষক হয়েই সংগঠনের নানা স্তরে রদবদল করে দলের অন্দরেই বিক্ষোভের মুখে পড়েন। নিগৃহীতও হন। দল সূত্রের খবর, তৃণমূল নেত্রী সে সময়ে সৌরভের পাশেই দাঁড়ান। প্রায় দেড় মাসের মধ্যে সৌরভের উদ্যোগে মোর্চা, সিপিএম, আরএসপি, কংগ্রেস থেকে বেশ কয়েকজন স্থানীয় নেতা, পঞ্চায়েত প্রতিনিধি, কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগদান করেন। আরএসপি-র দুই বিধায়ক অনন্তদেব অধিকারী ও দশরথ তিরকেও ওই সময়ে তৃণমূলে যোগ দেন। দশরথবাবু আলিপুরদুয়ার লোকসভায় ও অনন্তদেব ময়নাগুড়ি বিধানসভা জিতেছেন। সৌরভের কথায়, “অন্য দলের লোকজনকে লাগাতার টেনে আনা থেকে শুরু করে সংগঠনে প্রয়োজনীয় রদবদল, সব ব্যাপারেই দিদির (মুখ্যমন্ত্রী) কথা শুনে পদক্ষেপ করেছি। তাতেই সাফল্য এসেছে।”
তৃতীয়ত, চা বলয়ে মানে ২৭৮টি চা বাগান এলাকায় ভাল ফল করতে গেলে যে আদিবাসীদের বড় অংশকে পাশে রাখতে হবে সেই হিসেব কষাতেও সফল তৃণমূল। আদিবাসী বিকাশ পরিষদ অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও তৃণমূলকে সমর্থন করেছিল। বিকাশ পরিষদের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘সাঙ্গে দাই’ (বীরাঙ্গনা) সম্মান দেওয়া হয়। ভোটের ফল প্রকাশের দু’দিন আগে পরিষদের রাজ্য সভাপতি বিরসা তিরকেকে বঙ্গভূষণ সম্মান দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। পরিষদ অবশ্য আরও অনেক কিছু আশা করছে। পরিষদের প্রথম সারির নেতা তেজকুমার টোপ্পো বলেন, “আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য অনেক কাজ এখনও হয়নি। তা করানো হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তা হবে।”