সম্প্রতি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান হয়ে গেল শিলিগুড়িতে। ছবিটি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।
খবরটা এসেছিল রেডিওতে। যতদূর মনে করতে পারলেন সম্ভবত বিকেলে।
দেশভাগের ক্ষত তখনও দগদগে। উদ্বাস্তু শিবির তখনও চলছে। ১৯৫০ সালে পরিবারের সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে শিলিগুড়িতে এসেছে সেই কিশোরও। অচেনা ঠিকানা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যত একমুহূর্তের জন্যও ছেড়ে আসা পরিজন আর বাড়ি, উঠোন, খেত, বকুলতলার কথা ভুলতে দেয়নি। তেমনিই এক মুহূর্তে রেডিও জানাল, ছেড়ে আসার ‘দেশে’র প্রাক্তন সহনাগরিকদের আন্দোলনে রাষ্ট্রের গুলি চলেছে। সীমান্তের ও পার থেকে একের পর এক ছাত্রের মৃত্য সংবাদ আসছে। তখন বয়স ১৫-এর কাছাকাছি। এলাকার কিশোর বালকদের জুটিয়ে তারাও শিলিগুড়িতে চেঁচিয়ে উঠেছিল রেডিওতে শোনা একটি স্লোগান। জয় বাংলা। ঘটনাটি ইতিহাসে লেখা নেই। তবে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি শিলিগুড়িতেও যে স্লোগান উঠেছিল তার সাক্ষ্য, স্মৃতি এখনও গেঁথে রয়েছে বীরেন চন্দের মতো একসময়ের ‘ছিন্নমূল’ সেই সব বালক-কিশোরদের মনে, যাঁরা এখন প্রবীণ।
প্রতি বছরই ২১ ফেব্রুয়ারিই শিলিগুড়ি মিছিলে পা মেলায়, আলোচনায় বসে। গান, কবিতায় শ্রদ্ধা জানায় ভাষা শহিদদের। এ বারেও ঢের আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। ওপরের ঘটনাটির কথা জানিয়েছেন বীরেন চন্দ। দেশভাগের সময়ে ‘উদ্বাস্তুদের’ নিয়ে তথ্যচিত্রের জন্য সম্প্রতি বীরেনবাবুর সাক্ষাতকার নিয়ে গিয়েছেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা চিত্র পরিচালক তানভির মোকাম্মেল। শিলিগুড়িতে ভাষা দিবস উদযাপনের নানা গল্প শুনে উচ্ছসিত হয়ে উঠেছিলেন তানভির। সরকারি অনুষ্ঠান তো বটেই, বেসরকারি নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনও আজ, শনিবার সকাল থেকে নানা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করে রেখেছে শিলিগুড়িতে।
সত্তর ছুঁইছুই বীরেনবাবু জানালেন, তাঁর কাছে ভাষা দিবস যতটা গর্বের ততটাই যন্ত্রণারও। তিনি বললেন, “বাংলা ভাষার জন্য এতবড় আন্দোলন অবশ্যই গর্বের। কিন্তু সে সময় যাঁরা গুলিতে বুক পেতে দিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে মনে মনেই যেন একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাই এখনও এই দিনটায় স্বজন হারানোর কষ্ট পাই।” প্রতিবছরই ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে দিনভর মিছিল, আলোচনা চক্রে ব্যস্ত থাকেন। বললেন, “শরীর অসুস্থ থাকলেও, এ দিনটা বাড়িতে বসে থাকার নয়। এবারও কয়েকটি আলোচনা চক্রে যাব। যতদিন বাঁচব, ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে হাজির থাকব।”
তথ্য সংস্কৃতি দফতরের উদ্যোগে এবং ‘উবাচে’র ব্যবস্থাপনায় শিলিগুড়ির নীলনলিনী স্কুলে শনিবার বিকেল থেকে শুরু হবে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠান। বাচিক শিল্পীদের সংস্থা উবাচের তরফে পারমিতা দাশগুপ্ত জানালেন, নানা আঙ্গিক, বিভিন্ন মেজাজে অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে। কবিতা, গান এবং কথার কোলাজে উবাচের নিজস্ব প্রয়োজনা ‘হৃদ মাঝারে সোনার বাংলা’ থাকছে অনুষ্ঠানে। সেই সঙ্গে চারটি নাচের দল, দু’টি গানের দলের অনুষ্ঠান রয়েছে। ছোটদের সমবেত আবৃত্তি, বড়দের স্বরচিত কবিতা পাঠের সঙ্গে নীলনলিনী স্কুলের পড়ুয়াদের নাটকও থাকছে এই আয়োজনে। থাকবে ভাষা আন্দোলন নিয়ে আলোচনাও। পারমিতা দাশগুপ্তের কথায়, “উবাচ ৫ বছর ধরে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান করছে। কিন্তু তারও আগে থেকে শিলিগুড়ি ২১ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন আয়োজন হয়ে আসছে। এ বছরও বিভিন্ন স্কুল এবং সাংস্কৃতিক সংস্থার অনুষ্ঠান রয়েছে।”
চলতি সপ্তাহেই শেষ হল শিলিগুড়ি ভাষা উৎসব। একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে ১৪ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুকনা থেকে দীনবন্ধ মঞ্চে নানা অনুষ্ঠান হয়েছে। সংস্কৃতি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন অনিন্দিতা চট্টোপাধ্যায় সহ বিভিন্ন শিল্পী এবং শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্যরা। দেশভাগের পরে শিলিগুড়িতে শিক্ষা বিস্তারের জন্য তৈরি হয়েছিল নানা স্কুল। বরদাকান্ত বিদ্যাপীঠ তার মধ্যে অন্যতম। এই স্কুলেও বিভিন্ন বছর ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে অনুষ্ঠান হয়েছে। এবারে অবশ্য মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অনুষ্ঠান মুলতুবি রাখা হয়েছে। তবে শিক্ষকদের একটি সংগঠনের ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান হবে শিলিগুড়ি হাকিমপাড়া বালিকা বিদ্যালয়ে। বিকেলে বাঘাযতীন পার্ক থেকে মিছিল শুরু হবে গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের। শহর পরিক্রমা করে সেই মিছিল শেষ হবে হিলকার্ট রোডে। সন্ধ্যায় সংগঠনের অফিসে রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং আলোচনা।
আজ অনুষ্ঠান রয়েছে দীনবন্ধু মঞ্চেও। শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) অনুষ্ঠানেও নাচ, গান কবিতা মঞ্চস্থ হবে বলে জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের কাছে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের তাৎপর্যও ব্যাখ্যা করা হবে বলে এসজেডিএ-এর তরফে জানানো হয়েছে।
মিছিল, স্লোগান, পোস্টার, গান কবিতায় আজ, শনিবার সকাল থেকেই ঢাকার রাজপথের সঙ্গে মুখরিত হওয়ার প্রস্তুতি সারা হয়ে গিয়েছে শিলিগুড়িরও।