শহর সংলগ্ন তিস্তা নদী।
তিস্তায় চর জাগত শীতের মুখে, সে চরে কাশবন ও কাশফুল। শৈশবের শহরের তিস্তা এবং করলা নিয়ে জানতে চাওয়ায়, সমরেশ মজুমদার ‘নদী ছিল, নদী নেই’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “তখন আমরা শেষ কৈশোরে, ওই কাশবনে আমাদের সিগারেট খাওয়ার শিক্ষা, প্রেমপত্র লেখার গোপন আস্তানা। তারপর এক রাতে তিস্তার বুকে বোম ফাটার শব্দ, ভোরে পাড় ভেঙে জল। তখন জলপাইগুড়ির কাছারির ঘাট থেকে বার্ণিশ পর্যন্ত জল আর জল। সেই জল শহরে ঢুকলে বলা হত বন্যা। তারপর বাঁধ হল, ব্রিজ হল। হল আটষট্টির বন্যা। শহর গেল দুমড়ে। তার পর নদীতে জল কমল, পাহাড় থেকে নামা তিস্তার জল অন্যত্র ব্যবহার করার জন্য নিয়ে যাওয়াতে তিস্তার বুকে শুধু চরের হাড়।”
ছাত্র জীবনে জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ায় থাকতেন সমরেশবাবু। তিনি লিখেছেন, “বাড়ির এ দিকে তিস্তা ও দিকে করলা। টলটলে নদী। তার উপরে দোলনা পুল। কখনও তিস্তার জল উজিয়ে ঢুকত করলায়। বিসজর্নের নৌকাগুলো প্রতিমা নিয়ে ভাসানের সন্ধ্যা সাজাত। কিন্তু করলার বুকে মাটি জমল। সেই মাটি জমতে জমতে চর গজিয়ে গেল। জল দাঁড়িয়ে পচা গন্ধ ছড়াল। আমার প্রিয় নদী এখন মৃত্যুশয্যায়।”
গোটা শহরকে আড়াআড়ি ভাবে দু’ভাগে ভাগ করেছে করলা নদী। কোনও একটি শহরের পুরো অংশকে একটি-ই নদীর দু’ভাগ করার ঘটনাটি ভৌগলিক ভাবেও বিরল। সে কারণে অনেকেই করলা নদীকে জলপাইগুড়ির ‘টেমস’ বলে থাকেন। ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীকে পর্যটনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারত বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। নদীতে ভাসমান রেস্তোরা, পার্ক, বোটিং, কেতাদুরস্ত নৌকা চালানোর যেমন সম্ভাবনা ছিল, তেমনই নদীর দু’পাড় সংস্কার করেও পার্ক, রেস্টুরেন্ট, পানশালা, বিনোদন-পার্ক, স্পা-রও যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল বলে তাঁদের মতামত।
একই ভাবে তিস্তার থেকেও জল নিয়ে যেমন জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা যেত, সেই সঙ্গে তিস্তার জল পরিস্রুত করে বোতলবন্দি করে বিক্রির সুযোগ রয়েছে। পুরসভা একসময়ে এ বিষয়ে উদ্যোগীও হয়েছিল। তিস্তার পলির কারণেই ময়নাগুড়ির বার্নিশ থেকে দোমহনী হয়ে শহর ঘেঁষা সারদাপল্লি এলাকার মাটি উর্বর। তরমুজ থেকে শুরু করে সব্জি চাষের আর্দশ জমি বলে ধরা হয়। জলপাইগুড়ি শহরকে ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া এই নদীর চারপাশ ফল প্রক্রিয়াকরণ, কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য অনায়াসে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল বলে মনে করা হয়।
অথচ দুই নদী ঘিরেই যেন ‘স্থিতাবস্থা’ চলছে। বছর তিনেক আগে করলায় বিষকাণ্ডের জেরে রাজ্য জুড়ে হইচই হওয়ার পরে করলা অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি হয়। সেই পরিকল্পনাও এখনও দিনের আলো দেখেনি বলে অভিযোগ। আরও নানা গালভরা পরিকল্পনা তিস্তা এবং করলা নিয়ে শোনা গেলেও সবই ফাইলবন্দি। অথচ ইতিহাস বলছে শহরের সৃষ্টির সময়ে এমন উদ্যোগহীনতা ছিল না। শহরের ইতিহাসের সঙ্গেই নাকি জড়িয়ে রয়েছে ব্যবসায়ীক উদ্যোগ। জলপাইগুড়ি নামের সঙ্গেই ব্যবসায়িক যোগাযোগ।
শহরের বুক চিরে যাওয়া করলা নদীর উপরে সেতু।
ভুটানি ভাষায় জে-লে-পে-গু-রি-এর অর্থ এমন জায়গা যেখানে গরম পোশাক কেনাবেচা হয়। তিস্তা পাড়ের এই শহরের একসময়ে ভুটান থেকে ব্যবসায়ীরা গরম পোশাক বিক্রির জন্য নিয়ে আসত, ফেরার সময়ে পাহাড়ে জীবনযাপনের রসদ কিনে নিয়ে যেত জলপাইগুড়ি থেকে। অসম, রংপুর বিভিন্ন এলাকার বণিকরাও শহরে আসতেন ভুটানিদের আনা গরম পোশাক সংগ্রহ করতে। তারপরে বৈকুন্ঠপুরের রাজধানী স্থানান্তিরত হয়ে আসে এই শহরে।
সমরেশবাবু বললেন, “সদিচ্ছা থাকলে নদী সংস্কার করেই শহরের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যায়। ভরা নদীতে বোটিং থেকে নদীর দু’পাশে যদি কার্নিভালের কথা ভাবা হয়, তবে পর্যটকরা আসবেন। পশ্চিমবঙ্গের কোনও শহরের বুকের উপর দিয়ে করলার মতো এমন সুন্দর নদী বয়ে যায়নি। সরকার যদি না পারে, তা হলে দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে প্রস্তাবটা রাখুক। নদীর সঙ্গে মানুষের জীবনও বদলে যেত।”