দলবদলের হিড়িক উত্তরের দু’জেলায়

একের পর এক নির্বাচনে হেরে সংগঠন ধরে রাখতে পারছে না বামফ্রন্ট। কোথাও বাম ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন কর্মী-সমর্থক, নেতারা। কোথাও আবার বাম ছেড়ে বিজেপিতে যোগদানের হিড়িক পড়েছে। লোকসভা নির্বাচনে হারের পরে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার জেলা জুড়ে ফুটে উঠেছে এই চিত্র। জেলার বাম নেতারাও ওই পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৪ ০২:০০
Share:

একের পর এক নির্বাচনে হেরে সংগঠন ধরে রাখতে পারছে না বামফ্রন্ট। কোথাও বাম ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন কর্মী-সমর্থক, নেতারা। কোথাও আবার বাম ছেড়ে বিজেপিতে যোগদানের হিড়িক পড়েছে। লোকসভা নির্বাচনে হারের পরে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার জেলা জুড়ে ফুটে উঠেছে এই চিত্র। জেলার বাম নেতারাও ওই পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন।

Advertisement

সিপিএম এবং আরএসপি এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের পরে এ বার সিপিআই থেকে বিজেপিতে যোগদান শুরু হল। সোমবার দলের জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তাপস বিশ্বাস অনুগামীদের নিয়ে দল বদল করেন। লোকসভা নির্বাচনের পরে দল বদলের হিড়িক চললেও জেলা স্তরের কোনও বামপন্থী নেতার বিজেপিতে যোগদান এই প্রথম। এ দিন দুপুর নাগাদ জেলা বিজেপি দফতরে তাপসবাবুদের হাতে দলীয় পতাকা তুলে দেন জেলা বিজেপি সভাপতি দীপেন প্রামাণিক এবং জেলা সম্পাদক বাপি গোস্বামী।

তাপসবাবু জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের অরবিন্দ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপপ্রধানও ছিলেন। সিপিআই নেতা ও কর্মী ছাড়াও এ দিন ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের তিন জন সিপিএম সদস্য অনুগামীদের নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন। এই প্রসঙ্গে সিপিআই-এর জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক গোপাল সরকার বলেন, “একটা হুজুগ চলছে। বিজেপিতে গেলে কি সন্ত্রাসের হাত থেকে বাঁচা যাবে? তাপসের মত দক্ষ বামপন্থী ছেলে গেরুয়া ঝাণ্ডা হাতে তুলে নেবে ভাবতে পারিনি।”

Advertisement

তাপসবাবুর অভিযোগ, ‘দেশ ও রাজ্যে রাজনীতিতে বাম প্রাসঙ্গিকতা শেষ হয়েছে। বিজেপি ছাড়া অন্য কোনও দলের পক্ষে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। দেশ ও রাজ্যে বাম নেতারা বিজেপি বিরোধিতার নামে দিনের পর দিন তঞ্চকতা করেছেন। তাই বাম দলে আর থাকতে চাইনি।” এ দিন ওই দলের দুই জেলা কমিটির সদস্য সুকুমার রায় ও কমল রায় বিজেপিতে যোগ দেন। তাপসবাবু জানান, ৭০০ সিপিআই কর্মী দলত্যাগ করেছেন। কোচবিহার জেলাশাসকের দফতরে তৃণমূলের সন্ত্রাস বন্ধ করার দাবিতে অবস্থান বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে জেলা ফরওয়ার্ড ব্লক। জেলা সম্পাদক তথা বাম নেতা উদয়ন গুহ বলেন, “এ কথা অস্বীকারের কোনও জায়গা নেই, যে বাম কর্মীদের অনেকেই হয় তৃণমূলে না হয় বিজেপি যোগ দিচ্ছেন। তৃণমূলের সন্ত্রাসের কাছে অনেকে পরাজয় স্বীকার করে নিচ্ছেন। একদল প্রতিরোধ করার জন্য বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন।” বামেরা কেন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না? সে প্রসঙ্গে উদয়নবাবুর যুক্তি, “একের পর এক নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ফলে বামেদের নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে। সেখানে বিজেপি উদীয়মান শক্তি। তাঁদেরই ভরসা করে মানুষ সে পথে হাঁটছে।”

কোচবিহার লোকসভার সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেই এগিয়ে তৃণমূল। শুধু কোচবিহার আসনে বিজেপি ২ লক্ষের উপরে ভোট পেয়েছে। এর পরেই শুরু হয় দল বদল। তৃণমূল দাবি করেছে, কোচবিহার উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রে রাজারহাট, টাকাগাছ, কোচবিহার দক্ষিণের ঘুঘুমারি, পাটছড়া, চান্দামারি, দিনহাটার নাজিরহাট, ওকরাবাড়ি, গীতালদহ, সিতাই, নাটাবাড়ি, শীতল খুচি, মাথাভাঙা থেকে প্রতিদিন বাম কর্মীরা তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। ১০ জনের উপরে পঞ্চায়েত সদস্য, ব্লকের নেতারা যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে।

গত রবিবার ঘুঘুমারি হাইস্কুলের মাঠে একটি সভায় ফরওয়ার্ড পঞ্চায়েত সদস্য সুবল ভাড়ালি, প্রাক্তন প্রধান সঙ্গীতা রায় সহ ৩৫০ জন বাম কর্মী তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। নাজিরহাটে বামেদের ৬ জন পঞ্চায়েত সদস্য, ২ জন পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য সহ কয়েকশ কর্মী তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তৃণমূলের জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “বামেরা মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তাই ওঁরা বার বার সন্ত্রাসের মিথ্যে অভিযোগ করছেন।” বিজেপির তরফে দাবি করা হয়েছে, কয়েকদিনে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় তিন হাজার বাম কর্মী-সমর্থক বিজেপিতে যোগ দেন। প্রতিদিন দলের জেলা পার্টি অফিসে কয়েকশ মানুষ ভিড় করছেন। দিনহাটা, সিতাই, শীতলখুচি, মাথাভাঙায় বিজেপি যোগদানের হিড়িক বেশি। এ দিন পুন্ডিবাড়িতে এক হাজারের বেশি বাম কর্মী-সমর্থক বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বিজেপির তরফে জানানো হয়, সন্ত্রাস, আর্থিক দুর্নীতি, কোনও মহিলা ঘটিত মামলায় অভিযুক্ত বাম নেতা-কর্মীকে দলে নেওয়া হবে না। দলের জেলা সম্পাদক নিখিল রঞ্জন দে বলেন, “দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে দেব না। এখন অনেক মানুষ দলে আসতে চাইছেন। আবেদন জমা নিয়ে খোঁজ নিয়ে তবেই দলে নেওয়া হচ্ছে।”

এদিন জেলাশাসকের দফতরের সামনে ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক পরেশ অধিকারী অভিযোগ করেন, কোথাও মানুষের ধান কেটে নেওয়া হচ্ছে। বাড়ি থেকে গরু, হাস, মুরগি নিয়ে যাচ্ছে তৃণমূল কর্মীরা। বাম কর্মীদের দোকানে তালা দেওয়া হচ্ছে। অনেকের বাড়িতে হামলা হচ্ছে। কেউ পুলিশে অভিযোগ জানালে তাঁকে লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা করছে। তাঁর দাবি, “মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন। পরিস্থিতি এখন এতটাই ভয়ঙ্কর, যে অত্যাচারিত হয়েও অনেকে মুখ খুলছেন না।”

জলপাইগুড়ির বিজেপি জেলা সম্পাদক বাপি গোস্বামী জানিয়েছেন, ১৯৭৮ সাল থেকে অরবিন্দ গ্রাম পঞ্চায়েত বামফ্রন্টের দখলে। কিছু দিনের মধ্যে তা বিজেপির দখলে চলে আসবে। জেলা বিজেপি সভাপতি জানান, শুধু অরবিন্দ গ্রাম পঞ্চায়েত নয় রামসাই, ভোটবাড়ি, দোমহনি-২, গড়ালবাড়ির মত ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত দলের দখলে চলে আসবে। তৃণমূলের সন্ত্রাস এবং বাম নেতাদের ভুল রাজনীতির প্রতিবাদে প্রচুর পঞ্চায়েত সদস্য ও বাম কর্মী দলত্যাগের জন্য তৈরি হয়ে আছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত রবিবার জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রে মেখলিগঞ্জ মহকুমার দশ সদস্যের ভোটবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের ফরওয়ার্ড ব্লক প্রধান সহ ছয় জন বিজেপিতে যোগ দেন। এতে ভোটবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত বামফ্রন্টের হাত ছাড়া হয়। এর আগে গত শনিবার জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনের সিটু নিয়ন্ত্রিত রেলওয়ে হর্কাস ইউনিয়নের স্থানীয় ইউনিট কমিটির সম্পাদক ও সভাপতি অন্তত দেড়শো কর্মী সমর্থককে নিয়ে বিজেপি প্রভাবিত ভারতীয় মজদুর মোচার্য় আসেন। এর আগে শুক্রবার ময়নাগুড়ি এলাকায় সভা করে অনুগামী দশ জন পঞ্চায়েত সদস্যকে নিয়ে বিজেপি-তে যোগ দেন বিধানসভা উপনির্বাচনের আরএসপি প্রার্থী দীনবন্ধু রায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement