এ ভাবেই দখল হয়ে যাচ্ছে সাহু নদীর পাড় এলাকা। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে একশ্রেণির জমির দালালদের দৌরাত্মের জেরে অতিষ্ঠ এলাকার বহু বাসিন্দা। একদা শান্তিপূর্ণ ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি ওই দালালদের রেষারেষিতে অনেক সময়েই অশান্ত হয়ে ওঠে। তখন তুলতুলে লালমোহনের স্বাদও তেতো মনে হয় অনেকের। দিনভর দুশ্চিন্তা তাড়া করে অনেক এলাকাবাসীকে। রাত নামলে আরেক অশান্তি। যথেচ্ছ বেআইনি মদের আসর, দেহব্যবসার অভিযোগও ওঠে ইস্টার্ন বাইপাসের বিস্তীর্ণ এলাকায়। এলাকাটি শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বছর দুয়েক আগে। অথচ নানাবিধ বেআইনি কারবার এতটুকুও কমেনি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। বরং, পুলিশ-প্রশাসন, ভূমিসংস্কার ও আবগারি দফতরের একাংশের বিরুদ্ধেও বেআইনি কারবারের মদত দেওয়ার অভিযোগ করেন অনেক বাসিন্দাই।
অভিযোগগুলি কেমন তা সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক। যেমন, একজনের জমি ভুয়ো নথিপত্র বানিয়ে আরেকজন বিক্রি করে দিয়েছেন। জালিয়াতিতে আরও এককাঠি দড় যাঁরা, তাঁরা একই জমির দু-তিন রকমের নথি বানিয়ে একাধিক জায়গায় বিক্রি দিয়েছেন। আবার কারও বড় জমি ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখে রাতারাতি অস্থায়ী চালা বানিয়ে লোক বসিয়ে তা দখল নেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। বাম আমলে এমন বড় মাপের ফাঁকা রায়তি জমি দখল করে কলোনি বসানোর ঘটনা কম নেই। তৃণমূল জমানায় তা কমা তো দূরের কথা, আরও যেন বেড়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। ইদানিং তো সাহু, জোড়াপানি, মহানন্দার চর দখল করার হিড়িক পড়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। দখলদারির ওই প্রবণতা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তৃণমূলের এলাকার নেতারা। এখন পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এলাকায় কান পাতলেই তৃণমূলের নেতা-কর্তাদের একাংশের বিরুদ্ধে ভুরি ভুরি অভিযোগ শোনা যায়। তা নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল এখন খোলাখুলি হয়। এক নেতা, আরেক নেতার নাম ধরে প্রকাশ্যে হুমকি দেন। দুই নেতার গোলমাল থামাতে দলের প্রদেশ নেতাদের হস্তক্ষেপ করতে হয়।
তাতে কি জমির কারবার থামানো যায়? এই প্রশ্ন তুলে তৃণমূলের ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির এক নেতার আক্ষেপ, “জমির কারবার করে লক্ষ-লক্ষ টাকার সম্পত্তি গড়ার স্বপ্নের পেছনে ছুটছে দলের একটা অংশ। কে, কাকে থামাবেন?” শিলিগুড়ি মহকুমা প্রশাসনের একজন প্রবীণ কর্মী তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। ওই সরকারি কর্মী ডাবগ্রামের গোরার মোড় এলাকায় ৫ কাঠা জমি কেনেন বছর পাঁচেক আগে। স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে, অফিস থেকে ঋণ নিয়ে ওই জমির টাকা মেটান। সম্প্রতি একজন ব্যবসায়ী ওই জমিতে পাঁচিল দেওয়ার কাজ শুরু করান। খবর পেয়ে সরকারি কর্মী সেখানে যান। ওই ব্যবসায়ী যে নথি দেখান, তাতে জমিটি তাঁকেও বিক্রি করা হয়েছে। আবার একই জমি সরকারি কর্মীর কাছেও বিক্রি করা হয়েছে। এটা কী করে সম্ভব? ভূমিসংস্কার দফতর, রেজিস্ট্রি অফিসে যোগসাজশ না থাকলে কী এমন জালিয়াতি সম্ভব? সরকারি কর্মীটি জানান, গোটা ঘটনার তদন্ত চেয়ে তিনি পুলিশ-প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছেন। ইতিমধ্যে জমি বিক্রেতা সংশ্লিষ্ট দালাল কিন্তু এলাকা ছেড়ে ফেরার হয়ে গিয়েছেন।
অবসরের পরে ডাবগ্রাম এলাকায় শান্তিতে থাকার জন্য একচিলতে জমি কিনে বাড়ি করেছেন একজন হোমগার্ড। ভোরে ও সন্ধ্যায় অনেকটা সময় ধরে ইস্টার্ন বাইপাসে হাঁটাহাঁটি করেন। মাঝেমধ্যেই সন্ধ্যার পরে ছোট গাড়ি রাস্তার ধারে ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করিয়ে গ্লাস-বোতল নিয়ে মদের আসর বসাতে দেখেন। এক দিন এনজেপি কানেক্টরের সামনে এক তরুণীর আর্তনাদ শুনে তিনি ছুটে গিয়ে দেখেন, ওই রকম গাড়ির মধ্যে বসানো মদের আসরে ওই তরুণীর উপরে অত্যাচারের চেষ্টা করছেন তিন যুবক। তিনি লাঠি জোগাড় করে তেড়ে যান। তরুণীকে উদ্ধার করেন। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, সন্ধ্যা থেকে প্রায় রাত দু’টো পর্যন্ত ইস্টার্ন বাইপাসের বিস্তীর্ণ এলাকা যেন সমাজবিরোধীদের দখলে চলে যায়।
পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা অনেকেই অবশ্য ওই সব অভিযোগ যুক্তিযুক্ত বলে মানছেন। ভূমিসংস্কার দফতরের এক কর্তা জানান, জমি জালিয়াতি রুখতে সমস্ত নথিপত্র কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যে কটি জমির মালিকানা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে তার নিষ্পত্তি দ্রুত করার চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান। আবগারি দফতরের এক পদস্থ অফিসার জানান, বেআইনি মদের কারবার রুখতে অভিযান বাড়ানো হয়েছে। শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি (সদর) অংমু গ্যামসো পাল বলেন, “পুলিশ নিষ্ক্রিয় এটা বলা ঠিক নয়। অভিযোগ পেলেই কঠোর পদক্ষেপ হচ্ছে। আরও নজরদারি বাড়ানো হবে।”
তবে পুলিশ-প্রশাসন দাবি করলেও জমি দালালদের দৌরাত্ম বা সমাজবিরোধীদের রমরমা কতটা কমবে তা নিয়ে অবশ্য এলাকার বাসিন্দাদের অনেকের সংশয় রয়েছে। কারণ, ডাবগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা শিলিগুড়ি পুরসভার আওতাভুক্ত হওয়ায় সেখানে জমির দাম ঊর্ধ্বমুখী। আগামী দিনে ফুলবাড়ি নিয়েও স্বপ্ন দেখাচ্ছেন শাসক দলের নেতা-কর্তারা। তাই দালাল-চক্র যেন একটু বেশি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। একঝলকে দেখে নেওয়া যাক, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে কী পরিকল্পনা করা হচ্ছে?
(চলবে)