গৌতম-রুদ্র কাজিয়ায় অনুদান হারাচ্ছে স্কুল

তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর কাজিয়ার জেরে প্রায় ১১ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় অনুদান হারাতে বসেছে এই শহরের ২২টি স্কুল। যার ফলে স্কুল উন্নয়নের নানা কাজ পিছিয়ে যেতে পারে আরও এক বছর।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৫৫
Share:

তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর কাজিয়ার জেরে প্রায় ১১ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় অনুদান হারাতে বসেছে এই শহরের ২২টি স্কুল। যার ফলে স্কুল উন্নয়নের নানা কাজ পিছিয়ে যেতে পারে আরও এক বছর।

Advertisement

নবম ও দশম শ্রেণির জন্য হাই স্কুলগুলিকে রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা মিশনের অনুদান দেয় কেন্দ্র। কিন্তু শর্ত হল, ওই টাকা পেতে হলে স্কুলের পরিচালন সমিতি সরকার-নির্দিষ্ট রীতিতে পুনর্গঠন করতে হবে। সেই নিয়ম অনুসারে শিলিগুড়ি শহরের ২২টি স্কুলের পরিচালন সমিতি গঠনের নির্দেশ জারি করেছিল শিক্ষা দফতর। কিন্তু দলীয় কাজিয়ায় সেই নির্দেশ খারিজ করতে হল। রাজ্য শিক্ষা দফতর থেকে শিলিগুড়ির ডিআই (স্কুলস)-কে বার্তা পাঠিয়ে ওই নির্দেশ আপাতত কার্যকর করতে নিষেধ করা হয়েছে।

কেন স্কুলশিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এই টালবাহানা? তৃণমূলের অন্দরের খবর, এ হল তৃণমূল বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য আর উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের দ্বন্দ্বের পরিণাম। শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, শিলিগুড়ি বিধানসভা এলাকার অন্তর্গত ২২টি স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি ও ২ জন করে মনোনীত সদস্য কারা হবেন, সেই তালিকা পাঠানো হয় জেলা থেকে। শিলিগুড়ির তৃণমূল বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য সেই তালিকা তৈরি করেন বলে দল সূত্রের খবর। সেই তালিকা মেনেই গত ২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা দফতর ওই স্কুলগুলির পরিচালন সমিতির সভাপতি ও দুজন করে শিক্ষানুরাগী সদস্যের নাম মনোনীত করে তালিকা জেলা শিক্ষা দফতরে নির্দেশিকা পাঠায়। কিন্তু, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব ওই তালিকা নিয়ে আপত্তি তোলেন। তারই ফলে শিক্ষা দফতর তা প্রত্যাহার করে নেয়। শীঘ্রই পরিচালন সমিতি গঠনের নয়া নির্দেশ পাঠানো হবে বলে শিক্ষা দফতর জানিয়েছে।

Advertisement

প্রকাশ্যে অবশ্য দায় এড়াচ্ছেন দুই নেতাই। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর দাবি, “এটা শিক্ষা দফতরেরব্যাপার। আমি অন্য দফতরের কাজে মাথা গলাই না।” শিলিগুড়ির তৃণমূল বিধায়ক রুদ্রনাথবাবু বলেন, “নির্দেশ প্রত্যাহারের খবর আমার জানা নেই। তাই কোনও মন্তব্য করব না।”

কিন্তু শহরের ২২টি স্কুলের কর্তৃপক্ষ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কারণ, দ্রুত সরকার মনোনীত পরিচালন সমিতি গঠিত না হলে কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রকল্প রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান (আরএমএসএ) বাবদ এ বছরের বরাদ্দ টাকা মিলবে না। সরকারি সূত্রেই জানা গিয়েছে, আরএমএসএ প্রকল্প থেকে শহরের ওই সব স্কুল পিছু গড়ে ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ মেলার কথা। কিন্তু, চলতি আর্থিক বছরের বরাদ্দ পেতে মার্চের আগেই সমিতি গঠন করে প্রকল্প-প্রস্তাব জমা দিতে হবে। তা না-পারলে ২২টি স্কুল ওই টাকা পাবে না। ফলে, সব মিলিয়ে শিলিগুড়ির স্কুলগুলির অন্তত ১১ কোটি টাকা হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্কুল মহলের অনেকেই।

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় দাবি করেছেন, স্কুলগুলির প্রাপ্য বরাদ্দ পেতে কোনও অসুবিধে হবে না। তাঁর বক্তব্য, “শিলিগুড়ির ২২টি স্কুলে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তাতে কিছু ত্রুটি থাকায় সংশোধন করা হবে। শীঘ্রই নয়া তালিকা পৌঁছে যাবে। তাই বরাদ্দ পেতে অসুবিধে হবে না। শিক্ষা দফতর সে দিকে খেয়াল রাখছে।” দলের নেতাদের কোন্দলের জেরে শিক্ষা দফতর নির্দেশ প্রত্যাহারে বাধ্য হল কি না, প্রশ্ন করলে শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য, “এটা দফতরের আভ্যন্তরীণ বিষয়। তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করা সমীচিন হবে না।”

তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে পরিচালন সমিতি পুনর্গঠন আটকে যাওয়া, আর তার জেরে রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক মিশনের বরাদ্দ টাকা না মেলার দৃষ্টান্ত অবশ্য রাজ্যে ভুরি ভুরি। শিক্ষা দফতর সূত্রে খবর, রাজ্যের ১২ হাজার হাইস্কুলের মধ্যে তিনশোরও কম বর্তমানে ওই অনুদান পাচ্ছে। অথচ ২০১৩ সালের নভেম্বরেই পরিচালন সমিতিগুলি পুনর্গঠনের নির্দেশ জারি করা হয়েছিল সব জেলায়। দলের অন্দরের খবর, সরকার মনোনীত সদস্য কারা হবেন, তাই নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে আটকে যাচ্ছে সমিতির পুনর্গঠন। তার ফলে কেন্দ্রের বরাদ্দ করা টাকা স্কুলপড়ুয়াদের কাজে লাগছে না। নতুন ক্লাসঘর তৈরি, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, প্রান্তিক এলাকায় শিক্ষকদের হস্টেল তৈরির মতো বহু কাজ বাকি পড়ে থাকছে।

শিলিগুড়িতেও একই ছবি দেখা যাচ্ছে। তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা সভাপতি তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব শিক্ষা দফতর থেকে জেলায় পাঠানো তালিকা দেখে দলের অন্দরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দলীয় সূত্রের খবর, সেখানে গৌতমবাবুর ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের নাম নেই। ঘটনাচক্রে, যাঁদের মধ্যে কয়েকজন শহরের নানা স্কুলের বিদায়ী পরিচালন সমিতির সভাপতি পদে রয়েছেন। যাঁদের একজন হলেন, শিলিগুড়ি গার্লস স্কুলের বিদায়ী সভাপতি জয়ন্ত কর। তৃণমূলের শিক্ষা সেলের কয়েকজন নেতা জানান, বিষয়টি জেনে গৌতমবাবু দলের প্রদেশ নেতৃত্বের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকী, ওই নির্দেশ বহাল রাখলে সামনে শিলিগুড়ি ভোটে দলীয় মহলে প্রশ্নের মুখে পড়ার আশঙ্কাও করেন গৌতমবাবু। এর পরেই তড়িঘড়ি ডিআইকে বার্তা পাঠিয়ে শিক্ষা দফতর থেকে ওই নির্দেশ স্থগিত রাখতে বলা হয়। শিলিগুড়ির ডিআই (মাধ্যমিক) প্রাণগোবিন্দ সরকার বলেন, “যে নির্দেশ এসেছিল তা আপাতত কার্যকর করতে হবে না বলে বার্তা পেয়েছি। এর বেশি কিছু বলব না।”

এই ঘটনায় স্কুল মহলে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। একাধিক স্কুলের বিদায়ী পরিচালন সমিতির সদস্য তথা তৃণমূল নেতাদের কয়েকজন জানান, দলীয় স্তরে আলোচনা করে তালিকা তৈরি করলে এমন সঙ্কট তৈরি হতো না। দলের দুই গোষ্ঠীর টানাপড়েনের জেরে যদি চলতি বছরে বরাদ্দ না মেলে তা হলে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকদের ক্ষোভের মুখে পড়ার আশঙ্কাও করছেন তৃণমূল নেতাদের অনেকেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement