অসমাপ্ত পড়ে শেড।
চম্পাসারি মোড়ের কাছে রাস্তার ধারে শাক-সব্জির বাজার। সকাল থেকে দিনভর ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়। যানজটও তেমন। ফলে, ওই এলাকায় রাস্তার ধার থেকে বাজার সরাতে একটি বড় মাপের শেড নির্মাণের কাজে নামে এসজেডিএ। সেই পরিকল্পনা কী ভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে সেটা ওই এলাকায় গেলেই বাজারের প্রায় সব ব্যবসায়ী ফলাও করে বলবেন। কী ভাবে সরকারি টাকা অপচয় হয়েছে তারই যেন সেরা দৃষ্টান্ত হতে পারে চম্পাসারির সেই বাজারের শেড ও লাগোয়া এলাকার নির্মাণ। এমনকী, সরকারি টাকায় তৈরি বাজারের বিশাল শেড কী ভাবে দিনরাত নেশার আসর, জুয়ার ঠেক সহ নানা অসামাজিক কাজের আখড়া হতে পারে তারও নমুনা হতে পারে চম্পাসারির পরিত্যক্ত শেডটি।
ওই নির্মাণের প্রেক্ষাপট ছিল এরকম: রাস্তার দুধার থেকে বাজার না সরালে শিলিগুড়ি শহরের গতি কোনদিন বাড়বে না। একটি বেসরকারি বিশেষজ্ঞ সংস্থা শিলিগুড়ির যানবাহনের গতি কী ভাবে বাড়তে পারে তা নিয়ে সমীক্ষার পরে ওই মত জানিয়েছিল। সেই সমীক্ষায় ধরা পড়েছিল, শিলিগুড়ির কোর্ট মোড় থেকে দার্জিলিং মোড়, চম্পাসারি থেকে এনজেপি, বিধান মার্কেট থেকে শালুগাড়া, এই কটি রুটে দিনের বেলায় গড়ে ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলাচল করে থাকে। কারণের মধ্যে ওই সংস্থাটি দেখিয়েছিল, রিকশা, রাস্তার ধারে পার্কিং, ট্রাফিক পুলিশের অদক্ষতা ও সংযোগকারী রাস্তার বেহাল দশা। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশের পরে শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এসজেডিএ) সংযোগকারী রাস্তার গতি বাড়ানোর জন্য আসরে নামে।
সেই প্রেক্ষাপটে বাম আমলেই পুরসভার মাধ্যমে কয়েকটি পাড়ার রাস্তার দুধারের শাক-সব্জি, মাছ বাজার সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কয়েক দফায় অন্তত ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। সুভাষপল্লি, হায়দরপাড়া, দক্ষিণ ভারতনগর, চম্পাসারি সহ নানা এলাকায় পাকা শেড তৈরির কাজও শুরু হয়। পুরসভা, এসজেডিএ-এর সঙ্গে ওই সব রাস্তার ধারের শাক-সব্জি, মাছ-মাংস বিক্রেতাদের চুক্তি হয়, শেড হলে তাঁরা সেখানে চলে যাবেন। রাস্তায় যান চলাচলে গতি আসবে। সংযোগকারী রাস্তায় গতি থাকলে মূল সড়কেও গতি বাড়বে।
কিন্তু, চম্পাসারিতেও তেমনই হয়েছিল। ২০০২ সালে চম্পাসারিতে শেড তৈরির কাজ শুরু করায় এসজেডিএ। প্রথম দফায় ১৬৯টি স্টল তৈরি করে ব্যবসায়ীদের সেখানে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াও সপূর্ণ হয়। দ্বিতীয় দফায় আরও ১১০টি স্টল তৈরির কাজ হওয়ার কথা। সেটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ঘটল অন্যরকম ঘটনা। একদল শাক-সব্জি বিক্রেতা রাস্তার ধার থেকে শেড-এ গিয়ে বসতেই রাতারাতি শূন্যস্থান পূরণ করাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন একশ্রেণির নেতা-কর্তা। অভিযোগ, তাঁদের যোগসাজশে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ফের রাস্তার ধারে বসে পড়লেন নয়া শাক-সব্জি, মাছ-মাংস বিক্রেতারা। ফলে, রাস্তার হাল সেই তিমিরেই। দু’ধারে ফের শতাধিক ব্যবসায়ী শাক-সব্জি বসে পড়েছেন।
এখন এমন অবস্থা হয়েছে, চম্পাসারি বাজারের শেডের বেশির ভাগ অংশ ফাঁকা পড়ে থাকে। একটা বড় অংশ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। চম্পাসারির পথিপার্শ্বস্থ ব্যবসায়ী সমিতির মুখপাত্র বাপি সাহা বললেন, “আগের আমলে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যকে সব বলেছিলাম। উনি শেডে অসামাজিক কাজকর্ম বন্ধ করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। ওঁরা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরে তৃণমূলের নেতাদের ধরাধরি করেছি। তৃণমূল বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যকে বলেছি। মন্ত্রী হওয়ার পরে গৌতম দেব এসে সব দেখে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কাজের কাজ কতটা হয়েছে তা সকলেই দেখছেন।”
চম্পাসারিতে বাজার বসছে রাস্তায়।
এর পরে বাজারের ব্যবসায়ীরা অনেকেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রাক্তন ও বর্তমান দুই মন্ত্রীর সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কেউ আবার নেতা-মন্ত্রীদের অপরিকল্পিত পদক্ষেপের জন্য শহরের বাজারের বেহাল দশা ঘুচছে না বলে অভিযোগও করেন। চম্পাসারি বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী দেখালেন, একটি বিশাল শেডের মধ্যে মাঝারারি মাপের মাল্টিপারপাস হিমঘরও তৈরি করেছিল এসজেডিএ। সেই হিমঘর আলোর মুখ দেখেনি। যন্ত্র, সরঞ্জাম সব মরচে পড়ে গিয়েছে। হিমঘরের চাবি কোথায় কেউ জানেন না। লাগোয়া একটি বিশাল পাকা শেডের মধ্যে পড়ে রয়েছে প্রচুর কাশির সিরাপ, দিশি মদের বোতল। পাশের শেডে পড়ে রয়েছে মলমূত্র। কয়েক কোটি খরচ করে তৈরি ওই শেড-এ জমজমাট বাজার হওয়ার কথা ছিল। তা হলে রাস্তার দুধার মুক্ত হতো।
কিন্তু, সে সব কিছু হয়নি চম্পাসারিতে। বরং চম্পাসারি আগের চেয়েও বেশি যানজটে নাকাল। একই রকম দুরবস্থা শহরের নানা এলাকায়। বাম আমল থেকে তৃণমূল জমানা, বাজারের দুরবস্থা দূর হয়নি। ফলে, গোটা শহরেই বাজারের পরিষেবা নিয়ে হতাশা, ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। শিলিগুড়ি নাগরিক সমিতির মুখপাত্র দূর্গা সাহা বলেন, “শহরের বাজারগুলির সমস্যা মেটাতেই হবে। না হলে আগামী দিনে শহরে যানজট ভয়াবহ চেহারা নেবে। ভয়ঙ্কর দূষণ ছড়াবে। আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও পুরসভা-প্রশাসন-পুলিশের উপরে চাপ বাড়াচ্ছি। কারণ, এ ভাবে কিছুতেই চলতে পারে না। এই অবস্থা বদলাতেই হবে।”
নাগরিক সমাজের চাপে ফের কবে, কতটা বদলাবে শিলিগুড়ি, সেটাই এখন দেখার।
—নিজস্ব চিত্র।
(শেষ)
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার
থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-শহরের নাম’। অথবা চিঠি পাঠান,
‘আমার শহর-শহরের নাম’, আনন্দবাজার পত্রিকা,
১৩৬/৮৯ চার্চ রোড, শিলিগুড়ি ৭৩৪০০১।
প্রতিক্রিয়া জানান এই ফেসবুক পেজেও: