এনসেফ্যালাইটিস মোকাবিলা নিয়ে তোপের মুখে প্রশাসন

এনসেফ্যালাইটিসের এ বারের প্রকোপ মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০০১ সালে শিলিগুড়িতে মারণ জ্বরের প্রাদুর্ভাবের কথা। এ বার জানুয়ারি থেকে এখনও পর্যন্ত নানা ধরনের জ্বরে শুধু উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের মধ্যে ১২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৪ বছর আগে শিলিগুড়িতে তিন সপ্তাহের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৩৫ ছাড়িয়ে যায়। এ বার যেমন সরকারের ঘুম ভেঙেছে দেরিতে, সে বারেও তেমন পরে টনক নড়ে তৎকালীন বাম সরকারের।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৪ ০২:১৬
Share:

শুক্রবার দুপুর পৌনে একটা। জলপাইগুড়ি হাসপাতালের ফিভার ক্লিনিকে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভেরা।

এনসেফ্যালাইটিসের এ বারের প্রকোপ মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০০১ সালে শিলিগুড়িতে মারণ জ্বরের প্রাদুর্ভাবের কথা। এ বার জানুয়ারি থেকে এখনও পর্যন্ত নানা ধরনের জ্বরে শুধু উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের মধ্যে ১২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৪ বছর আগে শিলিগুড়িতে তিন সপ্তাহের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৩৫ ছাড়িয়ে যায়। এ বার যেমন সরকারের ঘুম ভেঙেছে দেরিতে, সে বারেও তেমন পরে টনক নড়ে তৎকালীন বাম সরকারের।

Advertisement

সে বার গোটা শহরে আতঙ্ক ছড়ায়। শিলিগুড়িতে বাইরের লোকজন আসা কার্যত বন্ধ করে দেন। শহরের দোকানপাট দিনেও বন্ধ হতে শুরু করে। মুখোশ লাগিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করতে দেখা যেত লোকজনকে। ওই সময়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে বাম সরকার। শেষ পর্যন্ত তৎকালীন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের উদ্যোগে রাতারাতি ২৫ জন চিকিৎসককে কলকাতা থেকে আনিয়ে প্রায় এক মাস মেডিক্যাল কলেজে রাখা হয়। অতিরিক্ত ২০টি ভেন্টিলেটর পৌঁছয় মেডিক্যালে। সকাল থেকে গভীর রাত সব কাজ ছেড়ে শুধু মারণ জ্বর প্রতিরোধের কাজের তদারকি করতে দেখা গিয়েছিল সেই মন্ত্রীকে। শুধু তাই নয়, যে সব রক্ত পরীক্ষা মেডিক্যাল কলেজে হয় না, তা করানোর জন্য শহরের নামী একাধিক বেসরকারি প্যাথোলজি ক্লিনিকে সরকারি খরচে তা করানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। সেই টাকা দিয়েছিল শিলিগুড়ি পুরসভা। শহরের নার্সিংহোম ও বেসরকারি প্যাথোলজি ক্লিনিক মালিকদের সংগঠন সূত্রের খবর, অন্তত ১৫টি জায়গায় এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু নির্ণয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ চাইলে, সেই সব পরীক্ষা কম খরচে করে দিতে বেসরকারি ল্যাবরেটরি কর্তৃপক্ষ তৈরি রয়েছেন। কিন্তু শিলিগুড়ি পুরবোর্ড এখন অকেজো। ফলে, উদ্যোগী হবে কে? পুর কমিশনার সোনম ওয়াংদি ভুটিয়া সব দেখাশোনা করছেন। তাঁর যুক্তি, “আমরা কী করব! স্বাস্থ্য দফতর সরঞ্জাম দিক। তা ছাড়া শিলিগুড়ি শহরের কেউ তো মারা যায়নি!”

রোগীদের পরিবারের তরফে কিন্তু বারবারই অভিযোগ করা হচ্ছে, পরিষেবা মিলছে না। এমনকী, মেডিক্যাল কলেজের অন্দরেও প্রবীণ অফিসার-কর্মীদের একাংশ রোগ মোকাবিলায় সুসংহত পরিকল্পনার ছাপ দেখা যাচ্ছে না বলে আক্ষেপ করেছেন। তবে শুক্রবার মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে দীর্ঘ বৈঠকের পরে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেছেন, “ঠিকঠাক তথ্য-পরিসংখ্যান আমাদের দেওয়া হয়নি। যাই হোক, পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে অনেক ভাল। আমরা সবরকম পদক্ষেপ করছি। রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা হবেই।” শুক্রবার জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার তৃণমূল যুব কংগ্রেসের তরফে মেডিক্যাল কলেজ লাগোয়া এলাকায় একটি ‘সেবাকেন্দ্র’ চালু হয়েছে তৃণমূল নেতা সৌরভ চক্রবর্তীর উদ্যোগে।

Advertisement

বাইরে তখন লাইন দিয়ে অপেক্ষায় রোগীরা।

রোগীদের আত্মীয়স্বজনের কেউ অভিযোগ করছেন, হাসপাতালের রোগী সহায়তা কেন্দ্রে গেলেও দায়সারা উত্তর মিলছে। তাতে কিছুটা বিব্রত হলেও সেবাকেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবী তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সকলে মিলে প্রতিটি অভিযোগের নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করলেন। সেবাকেন্দ্রের পক্ষ থেকে প্রয়োজনে অ্যাম্বুল্যান্স, রোগীর বাড়ির লোকজনের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।

মন্ত্রী গৌতমবাবু জানান, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার এবং দার্জিলিঙের জেলা প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য কর্তাদের নিয়ে শনিবার বৈঠক হবে। ঘটনা হল, জুলাইয়ে এনসেফ্যালাইটিসের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হওয়ার পর থেকে অন্তত ২০টি বৈঠক করেছে স্বাস্থ্য দফতর। তাতেও কাজের কাজ হয়নি কেন সেই প্রশ্ন উঠেছে রোগীদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেই। জুলাইয়ে মুখ্যমন্ত্রী তিন দিন দার্জিলিঙে থাকলেও যাতায়াতের পথে মেডিক্যাল কলেজে যাননি কেন সেই প্রশ্নও প্রতিনিয়ত তুলছেন বিরোধেী দলের সকলে। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুইঞাঁ বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর যখন সব কাজ ফেলে উত্তরবঙ্গে গিয়ে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে গোটা প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দেওয়ার কথা, তিনি তখন কলকাতায় অভিনেতা, অভিনেত্রী, গায়ক গায়িকাদের সম্মান জানাতে ব্যস্ত।” মানসবাবুরর মন্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই ওই সব ব্যক্তিদের সম্মান দেবেন, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তাঁর উত্তরবঙ্গের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। মানসবাবু মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গ পরিদর্শনে যাবেন।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোকবাবুর কথায়, “কয়েকজন আধিকারিককে সাসপেন্ড করলেই হল না। এর দায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। মুখ্যমন্ত্রীর উচিত ওই পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়া।” অশোকবাবুর বক্তব্য, সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গ সফরে আসার সময় এনসেফ্যালাইটিস নিয়ে হইচই হয়েছে। তার পরেও তিনি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাননি। পরে তিনি স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে পাঠালেন। তাঁর দাবি, “কাউকে সাসপেন্ড করতে হলে স্বাস্থ্য অধিকর্তাকেই করা হোক।”

দুই স্বাস্থ্যকর্তাকে সাসপেন্ডের ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বামপন্থী চিকিৎসক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স । তাদের বক্তব্য, বছরের পর বছর রোগ প্রতিরোধের সরকারি পরিকাঠামো ভেঙে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকেরা কি একা মশা দমনে নেমে পড়বেন বা মশা মারার ধোঁওয়া ছাড়বেন? তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন-এর সচিব শান্তনু সেন জানান, উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিস শুরু হওয়ার কথা ওই স্বাস্থ্যকর্মীরা সঠিক সময়ে স্বাস্থ্যভবনকে ও মন্ত্রীকে জানাননি এবং মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা নেননি বলেই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। তাঁর কথায়, “আমরা একে স্বাগত জানাচ্ছি, কারণ, জরুরি সময়ে প্রত্যেককে বাড়তি উদ্যোগী হতে হবে।”

ছবি: সন্দীপ পাল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement