আমাকে এবং আমার পাঁচ বছরের ভাইকে মাতৃহীন করেছে ডেঙ্গি নামক এই ভয়ঙ্কর ব্যাধি। আমাদের ভবিষ্যতকেও ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তার মধ্যে।
আমার মা পেশায় ছিলেন বিউটিশিয়ান। বাবার একটা ছোট দোকান আছে আমাদের বাড়ির নীচে। তাতে সংসার চলে যেত। কিন্তু মা চাইতেন, আমরা দুই ভাইবোন ভাল স্কুলে পড়ি। তাই উদয়াস্ত পরিশ্রম করতেন। নিজের কাজের জন্য এবং একই সঙ্গে আমাদের দিকে নজর রাখতেও।
সেই মানুষটা যখন হঠাৎ জ্বর হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন, তখন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। বেশ মনে আছে, ১০ অক্টোবর দুপুরে জ্বর ও শরীরে ব্যথা নিয়ে শিলিগুড়ির একটি সরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতাল থেকে বলা হয়, গ্যাসের জন্য এমন হচ্ছে। ডেঙ্গির জন্য যাতে রক্ত পরীক্ষা করা হয়, সে জন্য আমরা অনুরোধ করি। কিন্তু তা করা হয়নি। আমরা তখন বাইরের একটি ল্যাবরেটরিতে রক্ত পাঠানোর ব্যবস্থা করি।
ওই দিন বিকেলে রিপোর্টে ডেঙ্গি ধরা পড়লে আরেকটি সরকারি হাসপাতালে রেফার করা হয় মাকে। আমরা তখন চাইছিলাম, মায়ের ভাল ভাবে চিকিৎসা হোক। তাই আরও একটি সরকারি হাসপাতালমুখো না হয়ে ওঁকে নিয়ে যাই একটি নার্সিংহোমে। সেখানে এন্ডোস্কোপি যন্ত্র নেই জানিয়ে তারা অন্য আরেকটি নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে বলে। এই দ্বিতীয় নার্সিংহোমে এইচডিইউ-তে মাকে ভর্তি করানো হয়। তাঁরা জানান, ওই শয্যাই শুধু ফাঁকা রয়েছে।
চিকিৎসা শুরু হয়। আমরা বারবার জানতে চাই, প্লেটলেট দিতে হবে কিনা। কিন্তু কর্মরত আরএমও জানান, মা ভাল আছেন। প্লেটলেট লাগবে না। এমনকী, রাতে আমরা নার্সিংহোমে থাকতে চাইলেও কর্তৃপক্ষ থাকতে দেননি। তাঁরা জানিয়ে দেন, দরকার হলে ফোন করা হবে। পরদিন সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ নার্সিংহোম থেকে ফোনে জানানো হয়, মায়ের রক্তচাপ অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় আইসিইউতে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে এবং ভেন্টিলেটরে দেওয়া হবে।
ওই দিন বেলা ১০টা পর্যন্তও চিকিৎসক না আসায় আমরা কর্তৃপক্ষকে বারবার বলে তাঁকে ডাকতে বাধ্য করাই। বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ এসে তিনি জানান, মায়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক। শক সিনড্রোম দেখা দিয়েছে। আমরা তখন বাইরে থেকে অন্য চিকিৎসককে ডেকে আনলে তিনি এসে মাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
এখানেই কিন্তু শেষ হয়নি। এক রাতে মায়ের চিকিৎসার জন্য খরচ হয়েছে যে ৩৭ হাজার টাকা, তা তখন দিতে না পারায় বিকেল পর্যন্ত দেহ আটকে রাখা হয়।
এনএসওয়ান পরীক্ষায় মায়ের দেহে ডেঙ্গির জীবাণু মিলেছিল। নার্সিংহোমে ভর্তির সময় প্লেটলেট ছিল ৪২ হাজার। তবু মৃত্যুর কারণে চিকিৎসক ডেঙ্গির উল্লেখ করেননি। কেন এই দ্বিচারিতা? কেনই বা সঠিক চিকিৎসা হল না আমার মায়ের? কেনই বা আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, মা ভাল আছেন?
শহরে ডেঙ্গির প্রকোপে অনেকের মৃত্যু হয়েছে এ বছর। মাত্র কয়েক দিন আগেই আমরা মায়ের ছোটবেলার বন্ধু বাপন দে-র মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গিতে। আর কত ছেলেমেয়ে তাদের মা-বাবাকে হারাতে হবে? আর কত মৃত্যু লেখা আছে শিলিগুড়িবাসীর কপালে!
(মৃত শুক্লা ধরের মেয়ে)