শিক্ষক: ক্লাস নিচ্ছেন প্রতীম। নিজস্ব চিত্র
বারো বছরে একদিনও ছুটি নেননি ‘প্রতীম স্যার’। যে দিন স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেদিন থেকে হাজিরা খাতায় প্রতিদিনের উপস্থিতির সই রয়েছে তাঁর। কোনওদিন কোনও পড়ুয়াকে ক্লাসে না দেখলে বিকেলে স্কুল শেষ হওয়ার পরে খোঁজ নিতে রওনা দেন সেই পড়ুয়ার বাড়ি। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, পাশের কোনও বস্তির পড়ুয়াকে ঝোলা কাঁধে শিশি-বোতল কুড়োতে দেখলে তাকে টেনে এনে স্যার ভর্তি করিয়েছেন স্কুলে। জলপাইগুড়ির জয়ন্তীপাড়ার শিশু শ্রমিক স্কুলের শিক্ষক প্রতীম চৌধুরীর বিষয়ে এমনই জানাচ্ছেন স্থানীয়রা।
দীর্ঘ দিন ভাতা বন্ধ। কিন্তু তার জন্য স্কুলের দরজা কোনওদিন বন্ধ থাকেনি। জয়ন্তীপাড়া লাগোয়া রেলের জমিতে একাধিক বস্তি রয়েছে। সেখান থেকে পড়ুয়া জোগাড় করেন প্রতীম। অপুষ্টিতে ভোগা লিকলিকে চেহারা বছর পঞ্চাশের প্রতীমের। মুখে হালকা দাঁড়ি। খানিক কুঁজো হয়ে হাঁটেন। শহরেরই আনন্দপাড়ায় তাঁর বাড়ি। বিয়ে করেননি। জয়ন্তীপাড়া এলাকার কাউন্সিলর বনো সরকারের মন্তব্য, “স্কুলের শিক্ষকরা শুনেছি নিয়মিত মাইনে পান না। কতজন এসে ছেড়ে দিলেন। ওই প্রতীম মাস্টার আছে বলে স্কুলটা চলছে, না হলে কবে উঠে যেত!”
কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের প্রকল্পে দেশের সব জেলাতেই শিশু শ্রমিকদের স্কুল রয়েছে। আর পাঁচটা প্রাথমিক স্কুলের মতোই এর মিড-ডে মিল, পাঠক্রম, বই সব রাজ্য সরকার দেয়। সে সব নিয়ে সমস্যা নেই। স্কুল শিক্ষক এবং কর্মীদের মাস মাইনে বা ভাতা বরাদ্দ করে শ্রম মন্ত্রক। শিক্ষকদের ভাতা মাসে ৫ হাজার, কর্মীদের আরও কম। জেলার শ্রম দফতর শিক্ষক এবং কর্মীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মাইনে পাঠায়। মাঝে মাঝে বন্ধ থাকে ভাতা। মোট একান্ন মাসের ভাতা হয়নি। গত বছরের এপ্রিলের পরে আর ভাতা মেলেনি। জেলার সহকারী শ্রম আধিকারিক তথা শিশু শ্রমিক স্কুলের প্রকল্প আধিকারিক অঙ্কন চক্রবর্তীর মন্তব্য, “দিল্লির থেকে টাকা পাঠাচ্ছে না, তাই মাইনে দিতে পারছি না।”
২০০৮-এর ১ মার্চ জয়ন্তীপাড়ার স্কুল শুরু হয়। এখন স্কুলে পড়ুয়া ৪৩ জন। একটিই ক্লাস ঘর। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক প্রতীম হাত খরচা জোগাড় করেন গৃহশিক্ষকতা করে। বলেন, “ছ’শো টাকা পাই, তা দিয়ে চালিয়ে নিতে হয়। দুপুরে নিরামিষ ভাতের খরচ এক মামা হোটেলে দিয়ে দেন। রাতে দু’টো রুটি খাই। সারাদিনে চা-বিস্কুট হয় নিজে খাই, না হলে কোনও বন্ধু খাওয়ায়।” নেশা বলতে রাত জেগে বই পড়া আর লেখালেখি করা।
প্রাক্তন কাউন্সিলর নারায়ণ সরকার বলেন, “আগেকার দিনে এমন শিক্ষক দেখা যেত। খ্যাপা মাস্টারের স্কুল বললেই সকলে দেখিয়ে দেবেন।”
বিষয়টি জানেন প্রতীমও। মৃদু হেসে বলেন, “খ্যাপা বলে বলুক, সঙ্গে মাস্টারও তো বলে। পড়ানো ছাড়া একদিনও ভাল লাগে না।”